সকালবেলা সময়টা আমাদের প্রত্যেকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারন এই সময়টাই নির্ধারন করে আমাদের বাকি দিন কেমন যাবে । আমরা আমাদের পুরো দিনটা খুব ভালোভাবে এবং সফলতার সঙ্গে কাটাতে পারি প্রতিদিন সকালে মাত্র ৫ মিনিট প্রানায়ম অভ্যাসের মাধ্যমে । এখানে সকালে অভ্যাস করার মত কিছু প্রানায়ম (Pranayamas for Morning) সম্পর্কে আলোচনা করা হল, যা আমাদের সকলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
নিজেকে মানসিকভাবে সতেজ রাখতে প্রানায়ম একটি কার্যকরী অভ্যাস
প্রানায়ম্ বা যৌগিক শ্বাসকার্য প্রাচ্যের একটি অতি প্রাচীন অভ্যাস, যা ক্রমে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এটি প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে । প্রানায়ম মূলত যোগ অভ্যাসের একটি প্রকরন, যা নিয়মিত অভ্যাসের ফলে শ্বসনতন্ত্র সুস্থ এবং সুগঠিত হওয়ার পাশাপাশি মানসিক শান্তি, অবষাদ মুক্তির মত সমস্যা মোকাবিলা করতেও সাহায্য করে ।
বর্তমান সময়ে আমাদের দৈনন্দিন ব্যস্ততা, বহুমুখী জীবনযাপনের থেকে নিজেকে খানিকটা মুক্ত করতে আমরা যদি প্রতিদিন অন্তত কয়েক মিনিটের জন্য প্রানায়ম অভ্যাস করি, তাহলে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে তুলনামূলক অনেকটা ভালো থাকতে পারব । যারা শরীরচর্চা করে থাকেন তারা শরীরচর্চার আগে বা পরে, মেডিটেশনের সঙ্গে অথবা শুধুমাত্র প্রানায়ম অভ্যাস করে এর লাভ আপনি পেতে পারেন ।
Table of Contents
- 1 প্রানায়মের উপকারীতা (Benefits)
- 2 সকালের প্রানায়ম (Pranayamas for Morning)
- 3 অনুলোম-বিলোম প্রানায়ম (Anulom-Vilom Pranayama or Alternate-Nostril Breathing)
- 4 কপালভাতি প্রানায়ম (Kapalbhati Pranayama or Skull-Shine Breathing)
- 5 ভ্রামরী প্রানায়ম (Bhramari Pranayama or Bee-Humming Breathing)
- 6 দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama or Three-part Breathing)
- 7 ভস্ত্রিকা প্রানায়ম (Bhastrika Pranayama or Bellow Breathing)
- 8 প্রানায়মের ক্ষেত্রে কিছু সাধারন টিপস (Common Tips)
- 9 সারমর্ম
- 10 একই রকম কিছু বিষয়
প্রানায়মের উপকারীতা (Benefits)
এককথায় প্রানায়মের উপকারীতা হল – শ্বসনতন্ত্র সুগঠিত এবং উন্নত করে তোলা, কিন্তু সকালে প্রানায়ম বা যৌগিক শ্বাস কার্যের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল সচেতনতা বৃদ্ধি । এই কারনেই সকালে অন্তত ৫ মিনিটের প্রানায়ম অভ্যাস সারাদিনের কাজের প্রতি মনোনিবেশ বাড়িয়ে তুলে অনেক বেশী কর্মক্ষম করে তোলে ।
সকালের প্রানায়ম (Pranayamas for Morning)
বিভিন্ন ধরনের প্রানায়মের নিয়মাবলী এবং উপকারীতা সম্পর্কে উল্লেখ বিভিন্ন প্রাচীন শাস্ত্রে এবং গ্রন্থে পাওয়া যায় । এর মধ্যে থেকে ৫টি সহজ প্রানায়ম পদ্ধতি আপনি প্রতিদিন সকালে অভ্যাস করতে পারেন যা আপনার শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে সাহায্য করবে ।
অনুলোম-বিলোম প্রানায়ম (Anulom-Vilom Pranayama or Alternate-Nostril Breathing)
‘নাড়ি’ আমাদের শরীরের একপ্রকার সুক্ষ্ম চ্যানেল যা মাধ্যমে শক্তি প্রবাহিত হয় । এই নাড়িগুলি মধ্যে দিয়ে শক্তির প্রবাহ বিভিন্ন শারীরিক কারনে অনেক সময় ব্যাহত হয় । অনুলোম-বিলোম প্রানায়ম বা বিপরীত নাসারন্ধ্র প্রানায়ম অভ্যাসের মাধ্যমে আমাদের শরীরের নাড়ি মূলত ‘ইড়া’ এবং ‘পিঙ্গলা’ নাড়ি’ পরিশোধিত হয় এবং কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা ঠিক হয়ে যায় । এর পাশাপাশি সাইনাস সারাতেও এই প্রানায়ম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে ।
RELATED : অনুলোম-বিলোম প্রানায়ম
কিভাবে করবেন – মেরুদন্ড সোজা করে বসে হাতের সাহায্যে এক নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে অন্য নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়তে হবে । এইভাবে ২০-৩০ বার অভ্যাসের পরে ১ মিনিট স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস করে পুনরায় শুরু করুন ।
কপালভাতি প্রানায়ম (Kapalbhati Pranayama or Skull-Shine Breathing)
কপালভাতি একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ উজ্জ্বল কপাল । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শরীরে প্রচুর পরিমানে অক্সিজেনের সঞ্চালন হয় এবং রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায় । এর ফলে মুখ এবং কপালে একটা স্বাভাবিক দ্যুতি দেখা যায় । এই কারনে এই প্রানায়ম কপালভাতি নামে পরিচিত ।
কিভাবে করবেন – সোজা হয়ে বসে স্বাভাবিক শ্বাস নিন, এরপরে পেটের পেশী সংকোচনের মাধ্যমে শ্বাস ছাড়ুন । পেটের পেশী প্রসারনের ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শ্বাস ভিতরে প্রবেশ করবে, কিন্তু বলপূর্বক পেট সংকোচনের মাধ্যমে শ্বাস ছাড়তে হবে । এই পদ্ধতিতে শ্বাস টানা নিস্ক্রিয় কিন্তু শ্বাস ছাড়া একটি সক্রিয় প্রক্রিয়া ।
ভ্রামরী প্রানায়ম (Bhramari Pranayama or Bee-Humming Breathing)
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরেই আমরা অনেকসময় অবষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ি । এরকম অবস্থায় নিজেকে সতেজ করে তুলতে যে প্রানায়ম প্রচন্ড কার্যকরী তা হল ভ্রামরী প্রানায়াম । এছাড়া মানসিক চাপ মুক্ত করে প্রশান্তি প্রদান করার ক্ষেত্রেও এই প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে । এই প্রানায়ম অভ্যাসের সময় মুখ থেকে দীর্ঘ ‘হুমমমম’ শব্দ করা হয় যা শুনতে খানিকটা মৌমাছির গুনগুণের সদৃশ, তাই একে ভ্রামরী প্রানায়ম বলা হয়ে থাকে ।
কিভাবে করবেন – সোজা হয়ে বসে দুই হাতের তর্জনীর সাহায্যে দুই কানের কর্টিলেজ বা তরুনাস্থির উপর আলতো চাপ প্রয়োগ করে নাক দিয়ে শ্বাস টেনে মুখ দিয়ে ‘হুমমম’ শব্দ করার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাস ছাড়ুন । খেয়াল রাখবেন শ্বাস ছাড়ার সময় যাতে মুখ পুরোপুরি বন্ধ না থাকে ।
দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama or Three-part Breathing)
পতঞ্জলী যোগসূত্র অনুসারে এটি দির্গা শ্বাস ম প্রানায়ম নামে পরিচিত । এই প্রানায়ম অভ্যাসের সময় ফুসফুস (Lungs), মধ্যচ্ছদা (Diaphragm) এবং পেট (Belly) তিনটি অঙ্গ একত্রে ব্যাবহৃত হয় । মানসিক শান্তি প্রদানের ক্ষেত্রে এই প্রানায়ম অগ্রণী ভূমিকা পালন করে । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শরীরে প্রচুর পরিমানে অক্সিজেন রক্তের মাধ্যমে পৌছায়, যা আমাদের শরীরকে সতেজ এবং কর্মক্ষম করতে সাহায্য করে ।
কিভাবে করবেন – সোজা হয়ে বসে নাক দিয়ে শ্বাস টানুন । এক্ষেত্রে শ্বাস প্রথমে পেট অবধি পৌছাবে, এর পরে মধ্যচ্ছদা অতিক্রম করে অতিরিক্ত বাতাস ফুসফুস ভর্তি করবে । এরপরে শ্বাস ছাড়ার সময় প্রথমে ফুসফুসের থেকে বাতাস বেরোবে এবং তারপরে ক্রমানুযায়ী মধ্যচ্ছদা এবং পেটের থেকে বাতাস ছাড়ুন । এইভাবে ১৫-২০ বার অভ্যাসের পরে ১ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় করুন ।
ভস্ত্রিকা প্রানায়ম (Bhastrika Pranayama or Bellow Breathing)
কামারশালায় হাপরের ওঠা-নামার সঙ্গে এই প্রানায়ম অভ্যাসের সাদৃশ্য পাওয়া যায়, যেকারনে এটি ভস্ত্রিকা প্রানায়ম হিসেবে পরিচিত । এই যৌগিক শ্বাস পদ্ধতির উল্লেখ হটযোগ-প্রদীপিকা এবং ঘেরান্ডা-সংহিতায় পাওয়া যায় । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে ফুসফুস এবং মধ্যচ্ছদা সুগঠিত এবং অনেক বেশী কার্যক্ষম হয় । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শরীরের অভ্যন্তরীন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, তাই এই প্রানায়ম সাধারন ঠান্ডা লাগা সারানোর ক্ষেত্রে কিছুটা উপযোগী ।
কিভাবে করবেন – সোজা হয়ে বসে দুই হাত মুঠো করে কাঁধের সমান্তরালে রেখে বসুন । এবার শ্বাস টানার সময় দুই হাত মুঠো করা অবস্থায় সোজা উপরের দিকে তুলুন এবং শ্বাস ছাড়ার সময় আবার হাত দুটি প্রথম অবস্থানে ফিরিয়ে আনুন । এইভাবে ১০-১৫ অভ্যাসের পরে ২মিনিট বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় অভ্যাস করুন ।
প্রানায়মের ক্ষেত্রে কিছু সাধারন টিপস (Common Tips)
১) প্রানায়ম অভ্যাসের সময় পদ্মাসন, সিদ্ধাসন বা সুখাসনে বসে অভ্যাস করা উচিৎ ।
২) যাদের হাঁটু ভাঁজ করে বসায় অসুবিধা আছে, তারা চেয়ারে বসেও অভ্যাস করতে পারে । ত
৩) বসার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পিঠ, ঘাড় এবং মাথা সোজা এবং এক সরলরেখায় থাকে । পিঠ সোজা রাখার জন্য বসার সময় কুশন (Yoga Coushion) ব্যবহার করা যেতে পারে ।
৪) শ্বাস প্রশ্বাসের সময় মাথা ধরা বা শারীরিক কোনো অস্বস্তি হলে তৎক্ষণাৎ অভ্যাস বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকুন ।
৫) কোনোরকম জটিল শারীরিক সমস্যা থাকলে প্রানায়ম অভ্যাস করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেবেন ।
৬) প্রানায়ম সবসময় খোলামেলা স্থানে অভ্যাস করা উচিৎ, যেখানে যথেষ্ট বাতাস চলাচল করে ।
৭) কাঁধের হাড়ে বা পেশীতে সমস্যা থাকলে ভস্ত্রিকা প্রানায়ম অভ্যাস না করাই ভালো, এতে হীতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী ।
সারমর্ম
সকালে অভ্যাস করার মত কিছু প্রানায়ম (Pranayamas for Morning) নিয়ে আলোচনার করার একটাই উদ্দেশ্য, যাতে একজন অভ্যাসকারী তার সকালটা একটা ভালো অভ্যাসের মাধ্যমে শুরু করতে পারে । অনেকের পক্ষেই সকালে সময় বের করে প্রানায়ম অভ্যাস করা খুবই অসুবিধা জনক, সেক্ষেত্রে তারা সন্ধ্যে বেলাতেও অভ্যাস করতে পারেন ।
সকালে প্রানায়ম অভ্যাস (Pranayamas for Morning) করে আপনি কি পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন তা নীচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে ভুলবেন না । প্রানায়ম সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই আমাদের জানান । যথাসাধ্য উত্তর দিয়ে আপনাকে সাহায্য করব ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।