ভস্ত্রিকা প্রানায়ম (Bhastrika Pranayama) একধরনের নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকার্য, যার উল্লেখ ‘ঘেরান্ডা সংহিতা’ এবং ‘হটযোগ প্রদীপিকা’ পুস্তিকাতে পাওয়া যায় । প্রাচীনকালে যোগীরা একে ‘অগ্নির যৌগিক শ্বসনকার্য’ নামে চিহ্নিত করেছেন, যার অনেকরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায় । ভস্ত্রিকা একটি সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ ‘হাপড়’, যার সঙ্গে এই প্রানায়মে নিঃশ্বাস টানা এবং ছাড়ার সময়ে শারীরিক আন্দোলনের একটা সাদৃশ্য পাওয়া যায় । আধুনিক যোগ বিজ্ঞানে এই প্রানায়ম অভ্যাসের সময় ভঙ্গির কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে আরও ভালো ফল পাওয়ার জন্য ।
অন্যান্য প্রানায়মের মত এই প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রেও মূল লক্ষ্য নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকার্য । কপালভাতি প্রানায়মের সঙ্গে অনেকে এর সাদৃশ্য খুঁজে পান । যদিও মূল দুটি ব্যাপারে এই দুই প্রানায়মের মধ্যে পার্থক্য আছে । কপালভাতি প্রানায়মের ক্ষেত্রে পেট ব্যাবহৃত হয় কিন্তু এখানে ব্যাবহৃত হয় ফুসফুস । এছাড়া কপালভাতি প্রানায়মে নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় বলপ্রয়োগ করতে হয়, কিন্তু নিঃশ্বাস টানার সময় কোন বলপ্রয়োগ করতে হয় না । সংকুচিত পেট স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অক্সিজেন ভিতরে প্রবেশ করে ।
ভস্ত্রিকা প্রানায়মের বেলায় নিঃশ্বাস টানা এবং ছাড়া উভয়ের ক্ষেত্রেই বলপ্রয়োগ করতে হয়, যা বেশ খানিকটা কামারশালায় হাপড়ের ব্যাবহারের মত দেখতে লাগে
কপালভাতির নিঃশ্বাস ছাড়া এবং উজ্জয়ী প্রানায়মের নিঃশ্বাস টানার সঙ্গে এই প্রানায়মের মিল আছে । তাই যারা কপালভাতি এবং উজ্জয়ী প্রানায়ম অভ্যাস করেছেন, তাদের জন্য ভস্ত্রিকা অভ্যাস করা অনেক সহজ হবে ।
নিয়মিত ভস্ত্রিকা প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে আমাদের শরীরে, বিশেষত মস্তিষ্কে অক্সিজেনের প্রাচুর্য হয় । এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গতে রক্ত চলাচল বেড়ে যায় । এই প্রানায়ম অভ্যাসের পদ্ধতি এবং কি কি উপকার আমরা পেতে পারি চলুন সেগুলো জেনে নিই ।
Table of Contents
ভস্ত্রিকা প্রানায়ম (Bhastrika Pranayama) অভ্যাসের পদ্ধতি
প্রানায়ম অভ্যাসের কিছু নিজস্ব নিয়ম আছে, যেমন প্রানায়ম অভ্যাসের সবথেকে ভালো সময় সকাল এবং সন্ধ্যাবেলায় । সকালে খালি পেটে অভ্যাস করতে পারলে সবথেকে ভালো হয় । তবে সন্ধ্যায় অভ্যাস করতে চাইলে খেয়াল রাখবেন যেন অন্তত ৪-৫ ঘন্টার তফাৎ থাকে । ভস্ত্রিকা অভ্যাসের ক্ষেত্রেও নিয়ম এক, তবে গরমের সময় এই অভ্যাস সকালে সীমিত রাখাই শ্রেয় ।
অন্যান্য প্রানায়মের মতই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং অপেক্ষাকৃত শান্ত জায়গা আদর্শ । মেঝেতে কম্বল অথবা কুশণ পেতে বসতে পারেন । এবং যাদের মেঝেতে বসার ক্ষেত্রে সমস্যা তারা অবশ্যই চেয়ারে বসেও অভ্যাস করতে পারেন, তবে অভিজ্ঞ কারোর পরামর্শ মত অভ্যাস করা উচিৎ । তাহলে এবারে চলুন পদ্ধতিগুলি এক এক করে জেনে নিই ।
১) ভস্ত্রিকা প্রানায়ম অভ্যাসের জন্য পদ্মাসন, বজ্রাসন অথবা সিদ্ধাসনে বসতে পারেন । যেহেতু ভস্ত্রিকা প্রানায়ম একটি অগ্রিম স্তরের অভ্যাস, সেক্ষেত্রে এই ধরনের আসনে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় । তবে যাদের পক্ষে সম্ভব না, তারা সুখাসনে বসেও অভ্যাস করতে পারেন ,
২) মেরুদন্ড, ঘার এবং মাথা সোজা ও স্থির থাকবে । যদি মেরুদন্ড সোজা করে বসতে অসুবিধা হয়, সেক্ষেত্রে কুশণ বা কম্বলের উপর বসতে পারেন, যা মেরুদন্ড সোজা রাখতে সাহায্য করবে ।
৩) ভস্ত্রিকা অভ্যাসের ক্ষেত্রে নিঃশ্বাস টানা বা ছাড়া দুটোই হয় নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে । তাই লক্ষ্য রাখবেন মুখ যাতে বন্ধ থাকে ।
৪)আধুনিক যোগ বিজ্ঞানে, হাতের অবস্থানের পরিবর্তন করা হয়েছে এবং দেখা গেছে এটি তুলনামূলক বেশী লাভজনক । তবে প্রাথমিকভাবে হাত হাঁটুর উপর রেখে অভ্যাস করা যেতে পারে । দুই হাত মুঠো করে, ঐ অবস্থায় হাত দুটি কাধের সমান্তরালে শরীরের থেকে সামান্য দূরে রাখুন, যাতে হাত উপর-নীচে করতে কোনো অসুবিধা না হয় ।
দুই হাত জ্ঞ্যানমুদ্রা অথবা চিনমুদ্রায় দুই হাঁটুর উপর রেখেও ভস্ত্রিকা অভ্যাস করা যেতে পারে ।
৫) এই অবস্থায় জোরে নিঃশ্বাস নিন এবং একই সঙ্গে হাতদুটি সোজা উপরে তুলে, মুঠি খুলে দিন । এবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাস ছাড়ুন । নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় হাত দুটি মুঠো করে আবার পুর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনুন ।
৬) নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় ছাতি যতটা ফোলানো সম্ভব, ততটাই ফোলাবেন । এতে অনেক বেশী পরিমানে অক্সিজেন ফুসফুসে প্রবেশ করবে ।
৭) এইভাবে ৭ থেকে ১০ বার অভ্যাস করার পরে অন্তত ১-২ মিনিটের বিরতি দিয়ে আবার শুরু করুন । এইভাবে ৩বার ২-৩ মিনিটের বিরতিতে অভ্যাস করবেন । অর্থাৎ মোট ২১ থেকে ৩০ বার অভ্যাস করা হবে ।
৮) ভস্ত্রিকা প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে সবথেকে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হল ‘গতি (speed)’, অর্থাৎ কত তাড়াতাড়ি অভ্যাস করা যায় । এই প্রানায়ম অভ্যাস যেমন খুব ধীরে সুস্থে করা যায় ঠিক তেমনই খুব দ্রুত গতিতেও করা যেতে পারে । এখানে একটা কথা বুঝতে হবে, যে সবার শারীরিক ক্ষমতা সমান না । তাই যার পক্ষে যেমন গতিতে করা সম্ভব, তেমন ভাবেই করা ভালো । এতে কোনো অসুবিধা হয় না । তবে প্রাথমিকভাবে ধীর গতিতে অভ্যাস শুরু করা ভালো । অভ্যস্ত হয়ে উঠলে গতি বাড়ানো যেতে পারে ।
প্রানায়ম করার পরে কিছুক্ষন meditation অভ্যাস করুন, যাতে শ্বাস – প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয় ।
ভস্ত্রিকা প্রানায়মের (Bhastrika Pranayama) উপকারীতা
নিয়মিত ভস্ত্রিকা প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে আমরা যে উপকার পাই, সেগুলি হল –
- ফুসফুস এবং শ্বসনতন্ত্র সুগঠিত হয়, কর্মক্ষমতা বাড়ে । এছাড়া সংকোচন এবং প্রসারনের ফলে ফুসফুসের ধারনক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় ।
- শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে, ফলে ফুসফুস অনেক বেশী পরিশ্রুত হয় ।
- সাইনাস, ব্রঙ্কাইটিস এবং অন্যান্য শ্বাস জনিত সমস্যা কমায় ।
- রক্তে এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিমান বাড়ায় ।
- শরীরে এবং বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় ।
- মনে এবং শরীরে শক্তির প্রাচুর্য হয়, ফলে যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে অনেক বেশী উৎসাহ পাওয়া যায় ।
- বেশ কিছুদিন অভ্যাসের ফলে কাঁধের গতিশীলতার (mobility) বৃদ্ধি হয়, এবং ছাতি এবং ডায়াফ্রামের পেশি সুগঠিত হয় ।
- নিয়মিত অভ্যাসের ফলে পাচনতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
- অন্যান্য প্রানায়মের মত এটি অভ্যাসের ফলে মনোযোগ, সচেতনতা বাড়ে ।
- শরীরের দোষ – বাত, পিত্ত এবং কফের (doshas – vata, pitta and kapha) সাম্যতা বজায় রাখে ।
সতর্কতা
প্রানায়ম করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা-নিষেধ নেই, কিন্তু কিছু কিছু পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম থাকে যেগুলো জেনে রাখা দরকার ।
- ভরাপেটে কখনোই প্রানায়ম অভ্যাস করা উচিৎ না ।
- গর্ভাবস্থায় এবং ঋতুস্রাব (menstruation) চলাকালীন এই প্রানায়ম অভ্যাস থেকে বিরত থাকা উচিৎ ।
- এপিলেপ্সী বা হার্নিয়ার সমস্যা আছে, অথবা সদ্য পেটে কোনো অপারেশন হয়েছে, এইরকম পরিস্থিতিতে ভস্ত্রিকা প্রানায়ম অভ্যাস করা ঠিক না ।
- ভস্ত্রিকা প্রানায়ম একটি অগ্রিম স্তরের অভ্যাস, তাই কোনো ধরনের প্রানায়ম অভ্যাসের অভিজ্ঞতা না থাকলে, প্রশিক্ষকের সাহায্য নেওয়া বাঞ্ছনীয় ।
- উচ্চরক্তচাপ বা কোনো মানসিক সমস্যা থাকলে, অবশ্যই অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিয়ে এই প্রানায়ম অভ্যাস করা উচিৎ ।
সারমর্ম
ভস্ত্রিকা প্রানায়মের (Bhastrika Pranayama) অনেক প্রকরণ আছে, যেমন নিঃশ্বাস ধরে রাখা (কুম্ভক) বা পেশিবন্ধন ইত্যাদি । এখানে সবথেকে সহজ এবং সরল পদ্ধতিতে ভস্ত্রিকা অভ্যাসের উপায় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে । এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার অবশ্যই নিজেকে বুঝতে হবে, যে কিরকম গতিতে আমরা অভ্যাস করব । এবং একবার (৭ থেকে ১০ বার নিঃশ্বাস টানা এবং ছাড়া) করার পরে নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী বিরতি নিতে পারেন । এতে কোনো সমস্যা নেই ।
যারা প্রাথমিকভাবে প্রানায়ম অভ্যাস শুরু করার কথা ভাবছেন, তারা অবশ্যই এটা শুরু করার আগে নাড়ি-শোধন বা কপালভাতি প্রানায়ম অভ্যাস করে নেবেন কিছুদিন । তাহলে এটা অভ্যাস করতে সুবিধা হবে । এবং অভ্যাসের পরে আপনার অভিজ্ঞতা আমাদের জানান ।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।