নাড়ি শোধন প্রানায়ম বা nadi shodhan pranayama, যা বিপরীত নাসারন্ধ্র শ্বাসকার্য হিসেবেও পরিচিত । নাড়ি শোধন একটি সংস্কৃত শব্দ যেখানে ‘নাড়ি’ শব্দটির অর্থ প্রবাহ অথবা নল অথবা চ্যানেল (channel) এবং ‘শোধন’ শব্দটির অর্থ পরিশ্রুত করা বা বিশুদ্ধিকরন ।
মানবদেহে যেসকল নাড়ি বা সূক্ষ্ম শক্তি প্রবাহ থাকে, বিভিন্ন কারনে তাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় । নাড়ি শোধন একটি প্রানায়ম পদ্ধতি যা নিয়মিত অভ্যাসের ফলে নাড়ি পরিশ্রুত হয় এবং শরীরে ও মনের সমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে । নাড়ি শোধন প্রানায়ম সাধারনত অনুলোম বিলোম (onulom vilom) প্রানায়ম হিসেবেও পরিচিত ।
Table of Contents
যেসব কারনে নাড়িতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় –
১) অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন
২) মানসিক অবসাদ, উদ্বেগ এবং চাপের কারনে
৩) দীর্ঘকালীন শারীরিক অসুস্থতা
ইড়া এবং পিঙ্গলা নাড়ি
মানব দেহের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নাড়ি হল ইড়া এবং পিঙ্গলা ।
প্রতিবন্ধকতার কারনে ইড়া নাড়ি যখন সাবলীলভাবে কাজ করতে পারে না, তখন আমরা যে সমস্যাগুলি অনুভব করি সেগুলি – ঠান্ডা লাগা, বাম দিকের নাক বন্ধ হওয়া, মানসিক চাপ, হজমে গন্ডগোল এবং সামান্য দুর্বলতা ।
পিঙ্গলা নাড়ির প্রতিবন্ধকতার ফলে যখন সাবলীল্ভাবে কাজ না করতে পারে তখন যে সমস্যাগুলি হয় তা হল – ডান নাক বন্ধ, চামড়ার শুষ্কতা, গলা শুকিয়ে যাওয়া, বিরক্তি, অল্পতেই রেগে যাওয়া ।
নাড়ি শোধন প্রানায়ম (Nadi Shodhan Pranayama) অভ্যাসের পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া
অন্যান্য সব প্রানায়ামের মত নাড়ি শোধন প্রানায়ম অভ্যাসের আদর্শ সময় সকালবেলা অথবা সন্ধ্যায় । এবং সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও খোলামেলা জায়গা বেছে নেওয়া উচিৎ । এছাড়া অন্যান্য প্রানায়মের মত এটিও খালি পেটে অথবা খাওয়ার অন্তত ৪ ঘন্টা পরে অভ্যাস করা উচিৎ । নাড়ি শোধন প্রানায়ম অভ্যাসের প্রক্রিয়াগুলি তালিকা আকারে নিচে দেওয়া হল ।
১) আরামদায়ক ভাবে মেঝেতে দুই পা ভাঁজ করে (সুখাসনে) অথবা যাদের পক্ষে সম্ভব তারা পদ্মাসনেও বসতে পারেন । যারা মেঝেতে বসতে পারেন না, তারা চেয়ারে বসে অভ্যাস করতে পারবেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে দুই পায়ের পাতা মাটি স্পর্শ করে থাকে । মেঝেতে বসার জন্য আসন বা কুশণ ব্যাবহার করা যেতে পারে ।
২) মেরুদন্ড, ঘার এবং মাথা এক সরলরেখায় সোজা করে বসে প্রানায়ম অভ্যাস করা বাঞ্ছনীয় । তবে এতে কারোর অসুবিধা থাকলে পিঠে বালিশ বা কুশণ দিয়ে নিতে পারেন । এতে বসবার সুবিধা হবে ।
৩) এবার আরামদায়কভাবে বসে গভীরভাবে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ৫ সেকেন্ড ধরে রেখে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ছাড়ুন । এইভাবে ৫-৬ বার করার পরে নিজেকে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ মনে হবে ।
৪) আপনি যে হাতে বেশী স্বচ্ছন্দ সেই হাত ব্যাবহার করতে পারেন । এতে কোন অসুবিধা নেই । বোঝানোর সুবিধার্থে আমি ডান হাত ব্যাবহার করছি । ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা কে ভাঁজ করে হাতের তালুতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠর নীচের অংশে ঠেকিয়ে রাখুন (বিষ্ণু মুদ্রা) । বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আপনার ডান নাসারন্ধ্র বন্ধ করার জন্য এবং অনামিকা ও কনিষ্ঠা বাম নাসারন্ধ্র বন্ধ করার জন্য ব্যাবহার করবেন ।
৫) বাম হাতের অবস্থান হবে বা হাটুর উপর । তালু উপরের দিকে মুখ করে জ্ঞ্যান মুদ্রা ভঙ্গি তে রাখুন ।
৬) এবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান নাক বন্ধ করে, বাম নাক দিয়ে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস টেনে ২-৫ সেকেন্ড ধরে রাখুন । এবার ডান হাতের অনামিকা এবং কনিষ্ঠার সাহায্যে বাম নাক বন্ধ করে ডান নাক দিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ছাড়ুন । বাম নাক বন্ধ অবস্থায় ডান নাক দিয়ে নিঃশ্বাস টেনে ধরে রেখে, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান নাক বন্ধ করে, বাম নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ুন ।
৭) এইভাবে একবার প্রানায়ম করা হল । এইভাবেই কয়েকবার করে প্রতিদিন অভ্যাস করতে হবে ।
নাড়ি শোধন প্রানায়ম (Nadi Shodhan Pranayama ) অভ্যাসের কিছু সাধারন টিপ্পনী
১) প্রতিদিন প্রানায়ম অভ্যাসের পরে ৫-১০ মিনিট meditation অভ্যাস করা দরকার । এতে নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হবে ।
২) নাকের উপর খুব জোরে চাপ দেওয়ার দরকার নেই । হালকা চাপ প্রয়োগ করলেই হবে ।
৩) নাড়ি শোধন প্রানায়মের ক্ষেত্রে খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার দরকার নেই । স্বাভাবিক ছন্দে নিঃশ্বাস নিলেই চলবে । তবে নিঃশ্বাস ছাড়ার সময়কাল নিঃশ্বাস নেওয়ার সময়কালের থেকে বেশী যেন হয় ।
উপকারীতা
যেকোন ধরনের অভ্যাসকে নিজের দৈনিক কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত করার আগে, তার উপকারীতাগুলি জানা থাকলে কিছুটা বেশী উৎসাহ পাওয়া যায় । তাছাড়া আমাদের মধ্যে যে পরিবর্তনগুলি হয় তা বুঝতে সুবিধা হয় । তাহলে সংক্ষেপে জেনে নিই উপকারীতাগুলি কি কি ।
- প্রতিনিয়ত প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে আমাদের শ্বসনতন্ত্র অনেক বেশী কার্যক্ষম হয় ।
- নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকার্যের ফলে শরীরে অক্সিজেন উপযুক্ত পরিমানে সরবরাহ হয় ।
- প্রতিদিন নাড়ি শোধন প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে mindfulness পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে, যা আমাদের বর্তমান সময়কে উপভোগ বা অনুভব করতে সাহায্য করে ।
- মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কম হয়, যার ফলে অনেক বেশী স্বচ্ছন্দভাবে কোন কাজ করা যায় ।
- মনোযোগ করার ক্ষমতা বাড়ায় ।
- ডান ও বাম মস্তিষ্কের মধ্যে সমতা তৈরী হয় ।
- মানবদেহের নাড়ি পরিশ্রুত করে – যা আমাদের জীবনিশক্তির (প্রানা)প্রবাহ অনেক বেশী সহজ করে ।
- শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে ।
কিছু মনে রাখার বিষয়
প্রতিদিন নিয়ম করে প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে কিছু উপকারীতা পাওয়া যায় যেগুলো আমরা আগেই জেনেছি । কিন্তু এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে প্রানায়ম কখনোই চিকিৎসার বিকল্প নয় । যদি কোন ফুসফুসজনিত জটিল সমস্যা যেমন asthma, COPD থাকে, তাহলে অবশ্যই প্রানায়ম অভ্যাস শুরুর আগে চিকিৎ সকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন ।
প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে সময়ের কোন প্রতিবন্ধকতা নেই । কিন্তু প্রতিদিন অন্তত ৫ মিনিট অভ্যাস করতে পারলে ভালো । এর বেশী হলেও কোন ক্ষতি নেই । তবে প্রানায়ম শেষে meditation অভ্যাস শরীর ও মনের সমতা তৈরী করতে সাহায্য করে ।
লেখাটি পড়ে আপনাদের যদি কোন উপকার হয়, তাহলে আমাদের পরিশ্রম সার্থক বলে মনে হবে । লেখাটি সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না । যদি প্রানায়মের অন্য কোন উপকার আপনার অনুভূত হয় তাহলে সেটা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে ভুলবেন না । ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।
Very helpful 👍