কপালভাতি প্রানায়াম (Kapalbhati Pranayama) এর নামকরন হয়েছে দুটি সংস্কৃত শব্দের সংমিশ্রনে । ‘কপাল’ কথাটির মানে কপাল (forehead) বা মস্তিষ্কের অগ্রভাগ এবং ‘ভাতি’ কথাটির মানে উজ্জ্বল বা চলিত বাংলায় আমরা বলে থাকি চকচকে । তাহলে কপালভাতি কথাটির আক্ষরিক অর্থ কি দাড়ালো? ঠিকই ধরেছেন । ‘উজ্জ্বল কপাল’, যা সুস্থ এবং বুদ্ধিমান মস্তিষ্কের পরিচয় দেয় ।
Table of Contents
কপালভাতি প্রানায়ম (Kapalbhati Pranayama) কি?
এটি একটি জটিল নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের অভ্যাস । যারা প্রাথমিকভাবে শুরু করতে চলেছেন, তাদের কখনোই প্রশিক্ষকের সাহায্য ছাড়া কপালভাতি প্রানায়ম অভ্যাস করা উচিৎ না । কপালভাতি প্রানায়ম মূলত নিস্ক্রিয় শ্বাসগ্রহন, সক্রিয় এবং বলপূর্বক শ্বাসত্যাগ পদ্ধতিতে করা হয় । এই প্রানায়ম নিয়মিত অভ্যাসের ফলে শ্বসনতন্ত্র সুগঠিত এবং বিশুদ্ধ হয়, যা আমাদের শরীরে জমে থাকা টক্সিন এবং পরিত্যক্ত পদার্থ শরীর থেকে বের করে দেয় ।
কপালভাতি প্রানায়ম অভ্যাসের যে ৩টি পদ্ধতি আছে সেগুলি হল –
বাতক্রম (Vatakrama)
এই পদ্ধতিতে দুই পা ভাঁজ করে (সুখাসনে) অথবা পদ্মাসনে মাটিতে বসে অভ্যাস করতে হয় । এক্ষেত্রে শ্বাসগ্রহন নিস্ক্রিয় এবং শ্বাসত্যাগ সক্রিয় এবং বলপূর্বকভাবে করা হয় । বাতক্রম প্রানায়ম আমাদের আলোচনার মূল বিষয় ।
ব্যুতক্রম (Vyutkrama)
এটি কপালভাতি প্রানায়মের একটি প্রকরন যার উল্লেখ পাওয়া যায় ঘেরান্ডা সংহিতায় । এই প্রানায়মে নাক দিয়ে জল টেনে, মুখ দিয়ে নিষ্কাশন করতে হয় । এটি একটি উচ্চ মাত্রার প্রানায়ম, যা অভ্যাসের ফলে সাইনাস সংক্রান্ত সমস্যা কমে ।
শীতক্রম (Sheetkrama)
ঘেরান্ডা সংহিতায় কপালভাতি প্রানায়মের আরও একটি প্রকরনের উল্লেখ পাওয়া যায়, যার নাম শীতক্রম প্রানায়ম । এটি শতকর্ম বা ছটি বিশুদ্ধিকরন প্রক্রিয়ার একটি পদ্ধতি । এই পদ্ধতিতেও জলের ব্যাবহার করা হয়, তবে এটি ব্যুতক্রমের ঠিক উল্টো । অর্থাৎ এক্ষেত্রে জল মুখ দিয়ে নিয়ে নাকের মাধ্যমে নিষ্কাশিত করা হয় । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শ্লেষ্মা কমে ।
ব্যুতক্রম বা শীতক্রম প্রানায়ম তুলনামূলক অগ্রিম স্তরের এবং উচ্চমাত্রার অভ্যাস, তাই কখনোই এই প্রানায়ম কোন প্রশিক্ষকের প্রশিক্ষণ ছাড়া অভ্যাস করা উচিৎ নয় । আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় বাতক্রম প্রানায়ম যা সাধারন ভাবে কপালভাতি প্রানায়ম হিসেবে পরিচিত ।
কপালভাতি প্রানায়ম (Kapalbhati Pranayama) অভ্যাসের পদ্ধতি
প্রানায়ামের সকল প্রকরনের মত কপালভাতি প্রানায়ম অভ্যাসের আদর্শ সময় সকালবেলা অথবা সন্ধ্যায়, কারন খাওয়ার একদম পরেই কখনোই প্রানায়ম অভ্যাস করা উচিৎ ন্য । সকালে ঘুম থেকে উঠে অভ্যাস করতে পারলে সবথেকে ভালো । যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে খাওয়ার পরে অন্তত ৪ ঘন্টা ফাঁক থাকে । এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও খোলামেলা জায়গা যেখানে বাতাস চলাচল বেশী এমন স্থান প্রানায়ম অভ্যাসের জন্য বেছে নেওয়া উচিৎ ।
পদ্ধতিগুলি হল –
১) মাটিতে অথবা কম্বল পেতে মেঝেতে পা ভাঁজ করে অর্থাৎ সুখাসনে অথবা যারা পারবেন তারা পদ্মাসনে বসে এই প্রানায়ম অভ্যাস করতে পারেন । তবে মেঝেতে বসায় যাদের সমস্যা আছে তারা অবশ্যই চেয়ারে বসেও এই অভ্যাস করতে পারেন তবে সেক্ষেত্রে পায়ের পাতা দুটি যাতে মাটি স্পর্শ করে থাকে তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে । চেয়ারে বসে যারা অভ্যাস করবেন, তারা একটু সামনের দিকে এগিয়ে বসবেন যাতে মেরুদন্ড এবং ঘাড় সোজা থাকে । যেকোন প্রানায়ম বা meditation অভ্যাসের ক্ষেত্রে ঘাড় ও মেরুদন্ড সোজা থাকা জরুরী ।
২) হাতের অবস্থান এই প্রানায়মের জন্য তেমনভাবে প্রয়োজনীয় না । তবে স্বচ্ছন্দ ভাবে অভ্যাসের জন্য হাত দুটিকে দুই হাটুর উপর স্থাপন করে তালু উর্দ্ধমুখী রেখে জ্ঞানমুদ্রায় বসা যেতে পারে । অথবা একটি হাত নাভির উপর রেখে পেটের নড়াচড়া অনুভব করতে পারেন ।
৩) গভীরভাবে একটা নিঃশ্বাস নিন । এইবার নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় পেট ভিতরের দিকে টানুন । আপনি নিজেই যাতে অনুভব করতে পারেন, যে পেটের উপর চাপ দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ছেন ।
৪) আগেই বলেছি এই প্রানায়মের বেলায় শ্বাসত্যাগ সক্রিয় এবং শ্বাসগ্রহন নিস্ক্রিয় । তাই শ্বাসগ্রহন করার জন্য আলাদা করে কিছু করার দরকার নেই । পেট স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করে ।
৫) এইভাবে একবারে অন্তত ১০ থেকে ১৫ বার অভ্যাস করুন । তারপর ১ মিনিট চোখ বন্ধ করে বসে স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস নিন । ১ মিনিট পরে আবারও শুরু করুন । এইভাবে মোট ৩ বার অভ্যাস করবেন ।
৬) কপালভাতি প্রানায়ম অভ্যাসের সময় খেয়াল রাখবেন শ্বাস ত্যাগের সময় যাতে শরীরের ওপর অযথা চাপ না পড়ে । তাই প্রাথমিক ভাবে আস্তে আস্তে অভ্যাস করুন । অভ্যস্ত হয়ে গেলে শ্বাস ত্যাগের গতি বৃদ্ধি করতে পারেন ।
উপকারীতাগুলি কি কি
কপালভাতি প্রানায়ম (কাপাল্ভাতি প্রানায়ামা) অভ্যাসের পদ্ধতিগুলি আমরা জানলাম । এবার জানব এর উপকারীতাগুলি কি কি অর্থাৎ আমরা এটা কেন করব ।
- ফুসফুস সুগঠিত এবং পরিশ্রুত করে ।
- বিপাকীয় হার বৃদ্ধি করে ।
- হজমশক্তি বৃদ্ধি করে, কোষ্ঠকাঠিন্য কমায় ।
- গ্যাস এবং অ্যাসিড সংক্রান্ত সমস্যা কমায় ।
- খাদ্যের nutrients এর শোষণ এবং আত্তীকরন সহজ হয় ।
- নাড়ি পরিশ্রুত করার ক্ষেত্রেও এই প্রানায়ম কার্যকারী ।
- পেটের মাংসপেশি সংকোচন প্রসারনের ফলে পেটের গঠন সুগঠিত হয় ।
- স্নায়ু তন্ত্র এবং মস্তিষ্কের কোষ সমূহকে সতেজ করে ।
- মনকে প্রশান্তি প্রদান করে এবং শরীরে ক্লান্তি কমায় ।
কপালভাতি প্রানায়ম (Kapalbhati Pranayama) অভ্যাসের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন
১) কৃত্রিম পেসমেকার বসানো আছে এমন ব্যক্তি, হার্নিয়া, স্লিপ ডিস্কের কারনে পিঠে ব্যাথা, পেটে সদ্য অপারেশন হয়েছে এমন কারোর কপালভাতি প্রানায়ম থেকে বিরত থাকা উচিৎ ।
২) হৃদরোগ বা উচ্চরক্তচাপ যাদের আছে তাদের এই প্রানায়ম অভ্যাস ধীরে সুস্থে করা উচিৎ ।
৩) মহিলাদের গর্ভাবস্থায় এবং সন্তান প্রসবের তৎক্ষণাৎ পরে, এছাড়া ঋতুস্রাব চলাকালীন কপালভাতি প্রানায়ম অভ্যাস থেকে বিরত থাকা উচিৎ ।
৪) যারা প্রানায়মের প্রাথমিক ভাগ যেমন নাড়ি শোধন প্রানায়ম কিছুদিন অভ্যাস করেছেন, তারা নিজের থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কপালভাতি প্রানায়ম অভ্যাসের চেষ্টা করতে পারেন । যদি শ্বাস কার্যে কোন সমস্যা মনে হয় তাহলে আস্তে আস্তে করুন ।
৫) কপালভাতি প্রানায়ম একটি অগ্রিমস্তরের প্রানায়ম, তাই কোন মান্যতাপ্রাপ্ত প্রশিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করা ভালো । এতে সঠিক উপায়ে শেখা যায়, এবং খুব তাড়াতাড়ি উপকার পাওয়া যায় ।
৬) অবশ্যই খাওয়ার একদম পরেই অভ্যাস করা উচিৎ ন্য । অন্তত ৪ ঘন্টা তফাতে অভ্যাস করা যেতে পারে । তাই সবথেকে ভালো সকালে ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে অভ্যাস করা ।
সঠিক উপায়ে প্রানায়ম অভ্যাস করুন এবং এর উপকারীতাগুলো অনুভব করুন । যৌগিক শ্বাসকার্য একটি অভ্যাস যা অনেক বেশী আমাদের প্রশান্ত করে এবং কাজে উদ্যমী করে তোলে । নিয়মিত প্রানায়ম অভ্যস করুন । এবং আপনার অনুভব আমাদের সঙ্গে শেয়ার করুন । যদি কোন প্রশ্ন থাকে বা কোন মতামত থাকে আমাদের নিচে কমেন্টের মাধ্যমে জানান । ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।