উজ্জয়ী প্রানায়ম (Ujjayi Pranayama) একটি নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকার্য যা প্রাচীনকালে যোগীদের অষ্ঠাঙ্গ এবং বিন্যাস যোগের অঙ্গ হিসেবে ব্যাবহৃত হত । বর্তমানকালেও অনেকে যোগ অনুশীলনের সময়ে উজ্জয়ী শ্বাসকার্য করে থাকে । ‘উজ্জয়ী’ কথাটির অর্থ ‘বিজয়ী’ যা এসেছে দুটি সংস্কৃত শব্দ – ‘উদ (ud)’ এবং ‘জি (ji)’ মিলে তৈরী ‘উজ্জি (ujji)’ থেকে । উজ্জয়ী প্রানায়ম বিভিন্ন নামে পরিচিত, যেমন ‘Breath of Victory’, ‘Ocean Breath’ অথবা ‘Hissing Breath’ ।
Table of Contents
এই প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে নিঃশ্বাস টানার সময় পেট এবং বুক উভয়ই বেশ ফুলে ওঠে, ঠিক যেন যুদ্ধ জয়ী গর্বিত এবং আত্মবিশ্বাসী একজন সৈনিক, যে কারনে একে ‘Breath of victory’ বলা হয় । শ্বাস প্রশ্বাসের ফলে গলার (glottis) মধ্যে দিয়ে বাতাস চলাচলের সময় একটা শব্দ তৈরী হয়, সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে বাতাস এবং জলের সংমিশ্রনে তৈরী শব্দের সঙ্গে যার সাদৃশ্য পাওয়া যায় । এইকারনে একে ‘Ocean Breath’ ও বলা হয় ।
যে নামেই পরিচিতি হোক না কেন, কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যাতিরেকে উজ্জয়ী প্রানায়ম অভ্যাস প্রায় প্রত্যেকের জন্যই প্রযোজ্য । ধৈর্য নিয়ে অভ্যাস করে উজ্জয়ী প্রানায়মের সুফল যেকেউ উপভোগ করতে পারে । এছাড়া যারা যোগব্যায়াম অভ্যাসের সঙ্গে যুক্ত, এই শ্বাসকার্য অভ্যাস তাদের যোগ অভ্যাসের মান উন্নত করতে সাহায্য করবে ।
এই প্রানায়ম অভ্যাসের পদ্ধতি জানার আগে আমাদের একটা বিষয় জানতে হবে, যা এই প্রানায়ম অভ্যাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । অভ্যাসের সময় গলায় (glottis) সামান্য বলপ্রয়োগ করে একটা সংকোচনের সৃষ্টি করতে হবে, যাতে নিঃশ্বাস টানা বা ছাড়ার সময় শ্বাসনালীতে বায়ু চলাচল অনুভব করা যায় ।
নাক দিয়ে একটা বড় নিঃশ্বাস নিন । এবার মুখ খুলে নিঃশ্বাস ছাড়ুন, যাতে বাতাস সরাসরি আপনার গলা দিয়ে বাইরে বেরোয় এবং নিঃশ্বাস ছাড়ার জন্য জিহ্বার কোনো ব্যাবহার না হয় । এর ফলে একটা মৃদু ‘আহ’ শব্দ তৈরী হবে । এইসময় আপনি গলার (glottis) উপর সামান্য চাপ অনুভব করছেন । তাই তো? এইভাবে কয়েকবার অভ্যাস করার পরে মুখ সামান্য ফাঁক রেখে নিঃশ্বাস ছাড়বেন । এইভাবে ৭ থেকে ১০ বার অভ্যাস করার পরে নিঃশ্বাস ছাড়ার সময় গলায় চাপ প্রয়োগের ব্যাপারে আপনি স্বচ্ছন্দ অনুভব করবেন ।
নাক দিয়ে নিঃশ্বাস টানার এবং ছাড়ার সময় গলার (glottis) উপরে চাপ বজায় রাখুন । নাক দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাসের সময় আপনি লক্ষ্য করবেন গলায়(glottis) সংকোচনের ফলে একটা মৃদু ‘হিস হিস’ শব্দ তৈরী হয়, যে কারনে একে অনেক সময় ‘Hissing Breath’ ও বলা হয় ।
গলার উপর চাপ প্রয়োগ করে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস অভ্যাস করাই হল উজ্জয়ী শ্বাসকার্য বা উজ্জয়ী প্রানায়ম । প্রাথমিকভাবে এই অভ্যাসের সময় কাশি হতে পারে বা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস খুব ছোট হবে । এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই । এটাই স্বাভাবিক । প্রথমে খুব আস্তে আস্তে সময় নিয়ে ধৈর্য সহকারে অভ্যাস করুন । কিছুদিনের মধ্যেই আপনি উজ্জয়ী শ্বাসকার্যে নিজেকে স্বচ্ছন্দ মনে করবেন ।
বাকি সব প্রানায়মের মত উজ্জয়ী প্রানায়ম (ujjayi pranayama) অভ্যাস করার ক্ষেত্রে আদর্শ সময় সকাল অথবা সন্ধ্যা, কিন্তু দিনের যেকোনো সময়ে এই প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে । খালিপেটে অভ্যাস করাই শ্রেয়, এতে প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে সঠিকভাবে প্রানশক্তি সঞ্চার হয়, যা আমাদের ক্লান্তি, দুর্বলতা দূর করতে সাহায্য করে ।
একটা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, শান্ত এবং যথেষ্ট বাতাস চলাচল করে এমন স্থানেই প্রানায়ম অভ্যাস করা উচিৎ । প্রাথমিকভাবে বসে অথবা শুয়ে অভ্যাস করতে পারেন, তবে খেয়াল রাখবেন যাতে মেরুদন্ড এবং ঘাড় সোজা থাকে । মেঝেতে বসার ক্ষেত্রে যাদের অসুবিধা থাকে, তারা চেয়ারে বসেও অভ্যাস করতে পারেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে পায়ের পাতা দুটি যেন মাটি স্পর্শ করে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখবেন । যারা মেঝেতে বসে অভ্যাস করায় স্বচ্ছন্দ তারা সুখাসন, পদ্মাসন অথবা সিদ্ধাসনে বসে অভ্যাস করতে পারেন ।
১) প্রথমে ৫ থেকে ৭ বার ধীরে এবং গভীরভাবে শ্বাস টানুন এবং ছাড়ুন, যাতে নিজে স্বচ্ছন্দ অনুভব করতে পারেন প্রানায়ম অভ্যাসের জন্য ।
২) যখন আপনি মনে করবেন আপনি উজ্জয়ী শ্বাস কার্যের জন্য প্রস্তুত, তখন উপরের মত কয়েকবার অভ্যাসের মাধ্যমে গলায় সংকোচন তৈরী করুন ।
৩) এবারে নাসারন্ধ্র দিয়ে আস্তে এবং গভীরভাবে শ্বাস টানুন, যাতে ফুসফুস সম্পুর্ণ প্রসারিত হয় । যারা প্রথম প্রথম অভ্যাস করছেন, তার খুব অল্প পরিমান শ্বাস টানতে সমর্থ হবেন । এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই । নিয়মিত অভ্যাসের ফলে শ্বাস টানার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে ।
৪) গলার উপর চাপ অর্থাৎ সংকোচন বজায় রেখে নাক দিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ছাড়ুন ।
৫) খেয়াল রাখবেন উজ্জয়ী শ্বাসকার্য করার সময় যাতে কোনোভাবে শরীরের কোনো অংশে বা মুখে কোনোরকম চাপ না পড়ে । চেষ্টা করবেন যতটা সম্ভব আরামদায়ক ভাবে প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে ।
৬) নিঃশ্বাস টানার এবং ছাড়ার সময় মৃদু শব্দ সৃষ্টি হয় । উজ্জয়ী প্রানায়ম অভ্যাসের সময়ে চেষ্টা করুন সেই শব্দ শোনার এবং অনুভব করার ।
৭) এইভাবে গলায় সংকোচন বজায় রেখে প্রাথমিকভাবে ৭ থেকে ১০ বার অভ্যাস করতে পারেন । ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে সময় বাড়িয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট অবধি অভ্যাস করা যেতে পারে ।
৮) উজ্জয়ী শ্বাসকার্য শেষ করার পরে, ৩ থেকে ৫ বার যৌগিক শ্বাসকার্য করে নিতে পারেন । এতে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হবে ।
‘হটযোগ প্রদীপিকা’ অনুসারে উজ্জয়ী প্রানায়ম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রানায়ম অভ্যাস । নিয়মিত এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে বেশ কিছু উপকার পাওয়া যায় যা নিচে তালিকা আকারে দেওয়া হল ।
শরীরে এবং মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে এবং রক্ত চলাচল বাড়ায় ।
প্রানায়ম অভ্যাস প্রায় প্রতিটা মানুষের জন্য সুরক্ষিত, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এই অভ্যাস থেকে বিরত থাকা উচিৎ । উচ্চরক্তচাপ বা হৃদরোগীদের এই প্রানায়ম না করাই ভালো । তবে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক বা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করা যেতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে শ্বাসরোধের (কুম্ভক) বা পেশিবন্ধনের (বন্ধন) মত অগ্রিমস্তরের অভ্যাস করার প্রয়োজন নেই ।
যারা আগে কখনো কোনো ধরনের প্রানায়ম অভ্যাস করেনি, তাদের ক্ষেত্রে নিজে থেকে উজ্জয়ী প্রানায়ম অভ্যাস উচিৎ না । এক্ষেত্রে তারা কোনো অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিতে পারেন অথবা নাড়ি শোধন প্রানায়ম দিয়ে অভ্যাস শুরু করতে পারেন ।
গলা জোর করে খুব শক্ত করবেন না, এতে গলায় অযথা চাপ পড়বে । এছাড়া শরীরের কোথাও চাপ দিয়ে প্রানায়ম অভ্যাস করা ঠিক নয় ।
উজ্জয়ী প্রানায়ম অভ্যাসের সময় ক্লান্তি বা মাথা ভার লাগলে তৎক্ষণাৎ অভ্যাস করা বন্ধ করে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিন ।
উজ্জয়ী প্রানায়ম (Ujjayi Pranayama) একটি অগ্রিমস্তরের নিয়ন্ত্রিত শ্বাস কার্য অভ্যাস, যা সাধারনত একজন অভিজ্ঞ ব্যাক্তির উপস্থিতিতে করাই বাঞ্ছনীয় । গলায় চাপ বা সংকোচন সৃষ্টির জন্য যতটা সম্ভব সহজ এবং সরল পদ্ধতি এখানে আলোচনা করা হয়েছে । প্রাথমিকভাবে আঙ্গুলের সাহায্যে গলার উপর চাপ সৃষ্টি করেও এই প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে, কিন্তু তা অনেক সময় অভ্যাসকারীকে সমস্যায় ফেলতে পারে ।
উজ্জয়ী প্রানায়ম করার বেশ কিছু স্তর আছে যেমন পেশিবন্ধন (বন্ধন) বা শ্বাসরোধ (কুম্ভক), যা আরও অগ্রিমস্তরের অভ্যাস হিসেবেই পরিচিত । তাই আমরা এখানে উজ্জয়ী প্রানায়মের সাধারন স্তর নিয়ে আলোচনা করেছি, যা আপনাদের কিছুটা হলেও সাহায্য করবে অনুশীলন করার জন্য ।
এই প্রানায়ম অভ্যাসের সময় যদি কোনো সমস্যা অনুভব করেন বা অভ্যাসের ফলে আপনি কি সুফল পেয়েছে আমাদের জানাতে পারেন । আপনার মতামত বা কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানান । এছাড়া ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।
আমরা সাধারনত একটা কথা বলে থাকি যে কোনোকিছুই অতিরিক্ত ভালো না । এই একই কথা…
শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই একটি বহুল প্রচলিত অভ্যাসের নাম হল “যোগ”…
‘স্বাস্থ্য’ কথাটা শুনলে আমরা সাধারনভাবে শুধু শরীরের কথাই ভেবেথাকি, ঠিক পদ্ধতিতে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের…
প্রাচীনকাল থেকে যেসকল কৃষিজ শষ্য মানবজাতির কাছে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তার মধ্যে ডাল (Lens…
সূচনা (Introduction) প্রোটিন (Protein) একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রোনিইট্রিয়েন্ট (Macronutrient) যার উৎস (protein sources) আমাদের প্রতিদিনের গ্রহন…
যোগাভ্যাসের বিভিন্ন ধরনের আসন, যা আমাদের দেহের নীচের অংশ যেমন পা, কোমর পেট এবং পিঠ…