Nutrition

ভিটামিনের কার্যকারীতা (Function of vitamins)

ভিটামিনের কার্যকারীতা (function of vitamins) আমাদের জীবনপ্রবাহ বজায় রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ । ভিটামিন এবং জৈব উপাদান যা মানবদেহের জন্য একটি অপরিহার্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (essential micronutrient) হিসেবে পরিচিত । মানবদেহে বিভিন্ন অংশের বৃদ্ধি এবং সুস্থ থাকার জন্য ভিটামিনের প্রয়োজন হয়, কিন্তু তা অতি সামান্য পরিমানে । আমাদের জন্য মূল সমস্যাটি হল, অধিকাংশ ভিটামিন আমাদের সংগ্রহ করতে হয় খাদ্যের মাধ্যমে ।

কারন, মানবদেহে বেশীরভাগ ধরনের ভিটামিন তৈরী হয় না । যে কয় প্রকারের ভিটামিন তৈরী করতে সক্ষম, তার পরিমান অতি অল্প, যা কোনো কার্যপ্রনালীর জন্য যথেস্ট নয় । যেমন ভিটামিন C আমাদের ত্বকের জন্য প্রয়োজন । ভিটামিন C আমরা খাদ্যের মাধ্যমে সংগ্রহ করি, কারন আমাদের শরীরে ভিটামিন C উৎপন্ন হয় না । কিন্তু কুকুরের দেহে তাদের প্রয়োজনের তুলনায় যথেস্ট পরিমানে ভিটামিন C তৈরী হয় । তাই আমাদের খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন ধরনের micronutrients অর্থাৎ ভিটামিন এবং মিনারেলস এর জন্য ।

প্রতিটা ভিটামিন আমাদের শরীরে বিভিন্নরকম কাজ করে । এবং এই ভিটামিন আমরা বিভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিমানে আমাদের শরীরে সংগ্রহ করি ।

এখানে আমরা প্রতিটা ভিটামিনের কার্যকারীতা (function of vitamins), ঘাটতির ফলে কি হয়, উৎস কি কি এইসব নিয়ে আলোচনা করেছি ।

Table of Contents

ভিটামিন সংক্রান্ত কিছু সংক্ষিপ্ত বিষয়

এই নিয়ে বিশদে আলোচনায় যাওয়ার আগে কিছু বিষয় সংক্ষেপে জেনে নিই । যদিও এগুলো নিয়ে মূল প্রচ্ছদে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে ।

  • ভিটামিন সাধারনত ১৩ প্রকারের (ভিটামিন A থেকে ভিটামিন K) হয় । তবে কোনো কোনো সংস্থা ভিটামিন ১৪ প্রকারের বলে থাকে, যেখানে কোলিন (Choline) নামে একটি nutrient কে যোগ করা হয় ।
  • আমরা খাদ্যের মাধ্যমে সাধারনত জলে দ্রবনীয় ভিটামিন এবং চর্বি বা তেলে দ্রবনীয় ভিটামিন এই দুই ধরনের ভিটামিন সংগ্রহ করি ।
  • প্রয়োজনের বেশী পরিমানে গ্রহিত জলে দ্রবনীয় ভিটামিন খুব সহজে শরীর থেকে বের হয়ে যায় ।
  • প্রয়োজনের তুলনায় কমমাত্রায় বা বেশীমাত্রায় ভিটামিন গ্রহন, দুটোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ।
  • আমরা যেসকল খাদ্য খাই, ভিটামিনের উৎস হিসেবে সেগুলি সবথেকে ভালো । বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের থেকে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন আমরা সংগ্রহ করি । তাই সবরকম খাদ্য খাওয়া উচিৎ, যাতে উপযুক্ত পরিমানে nutrients আমরা সংগ্রহ করতে পারি ।

ভিটামিন A থেকে K (Vitamin A to K)

ভিটামিন হল একধরনের আনবিক যৌগ যা আমাদের শরীরের জন্য পরিহার্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (essential micronutrient), যা প্রতিদিন অতি অল্প পরিমানে প্রয়োজন হয় । আমাদের শরীরের বিভিন্ন কার্যপ্রনালী যেমন বৃদ্ধি, সুস্থ থাকা, বিভিন্ন অঙ্গ – প্রত্যঙ্গর কাজ করা এসবের জন্য বিভিন্ন ধরনের micronutrients আমাদের প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে ভিটামিন একটি মূল উপাদান । যে ১৩ টি পরিচিত ভিটামিন আমাদের জন্য খুব গুরুত্ব পূর্ণ সেগুলি হল – ভিটামিন A, ভিটামিন B1 (Thiamine), ভিটামিন B2 (Riboflavin), ভিটামিন B3 (Niacin), ভিটামিন B5 (Pantothenic Acid), ভিটামিন B6 (Pyridoxine), ভিটামিন B7 (Biotin), ভিটামিন B9 (Folate), ভিটামিন B12 (Cobalamin), ভিটামিন C (Ascorbic Acid), ভিটামিন D, ভিটামিন E, ভিটামিন K

জলে দ্রবনীয় ভিটামিন

এই ধরনের ভিটামিন শরীরে জমা হতে পারে না । তাই অতিরিক্ত জলে দ্রবনীয় ভিটামিন মূত্রের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে যায় । এই কারনে জলে দ্রবনীয় ভিটামিন নিয়মিত গ্রহন করতে হয়, যাতে শরীরে এই ধরনের ভিটামিনের অভাব না ঘটে ।

সকলপ্রকার ভিটামিন B এবং ভিটামিন C জলে দ্রবনীয় ভিটামিনের উদাহরন ।

তেলে বা চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিন

সাধারনত যকৃৎ এবং মানবদেহের ফ্যাটি টিস্যুতে এই ধরনের ভিটামিন সঞ্চিত থাকে । ফলে চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিন শরীরে বেশকিছু দিন আবার কখনো কয়েকমাস জমা থাকতে পারে । এই ধরনের ভিটামিন আমাদের শরীরে খাদ্যের মাধ্যমে গৃহীত ফ্যাট বা চর্বির সাহায্যে শোষিত হয় ।

ভিটামিন A, D, E এবং K তেলে বা চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিনের উদাহরন ।

দুই ধরনের ভিটামিনের সম্পর্কে একটু ভালোভাবে জেনে নিই, যাতে নিজেরাই কিছুটা হলে বুঝতে পারি কোনো ধরনের ভিটামিন আমাদের প্রতিদিনের খাওয়ারে ঘাটতি থাকছে, বা সেক্ষেত্রে কি করা যেতে পারে ।

ভিটামিন A – উৎস এবং কার্যকারীতা (Source and Function of Vitamin A)

ভিটামিন A একটি অসম্পৃক্ত পুষ্টিকর উপাদান । এটি একটি তেলে দ্রবনীয় ভিটামিন দুরকম ভাবে (রেটিনল এবং ক্যারোটিন) পাওয়া যায় ।  

প্রয়োজনীয়তা – স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিকাশ, রোগ প্রতরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, ভালো দৃষ্টিশক্তির জন্য ভিটামিন A মানবদেহের জন্য প্রয়োজন । এছাড়া ভিটামিন A আমাদের চোখের রেটিনার জন্য প্রয়োজন, যা স্বল্প আলোয় সঠিকভাবে দেখতে (low light vision) বা সঠিক রঙ চিনতে (colour vision) সাহায্য করে ।

উৎস –  দুধ, ডিম, গাজর, ব্রোকলি, মিষ্টি আলু, কুমড়ো, আম, বেল পেপার ইত্যাদি খাওয়ারে ভিটামিন A পাওয়া যায় ।

Carrot – Source of vitamin A

ঘাটতির ফল – ভিটামিন-A ঘাটতির ফলে রাত-কানা (night blindness) বা কেরাটোম্যালাসিয়া (Keratomalacia)র মত চোখের রোগ হয় । এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়, স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় ।

ভিটামিন B1 – উৎস এবং কার্যকারীতা (Source and Function of Vitamin B1)

এটি ভিটামিন B কমপ্লেক্স অন্তর্গত একটি ভিটামিন, যা থিয়ামিন (Thiamine)  নামেও পরিচিত । এটি একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন যা কার্বহাইড্রেটকে শক্তিতে রুপান্তর করতে সাহায্য করে ।  

প্রয়োজনীয়তা –  ভিটামিন B1  স্নায়ু তন্ত্র, পেট, অন্ত্র, মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্রের সমস্যা প্রতিরোধ করে । এছাড়াও বেরীবেরী নামক একটি রোগ প্রতিরোধ করে, যা মূলত হৃদয়, স্নায়ু এবং পাচনতন্ত্রের সমস্যা ।

উৎস – যেসব খাওয়ারে ভিটামিন B1 থাকে সেগুলি হল চাল, গম, চিঁড়ে, সুজি, বিভিন্ন দানা শষ্য, পাস্তা । এছাড়া বিভিন্ন ডাল যেমন মুগ, মসুর, ছোলা এসবেও ভিটামিন B1  পাওয়া যায় । প্রাণী জাতীয় খাওয়ার যেমন ডিম, মাছ এবং মাংসেও যথেষ্ট পরিমানে এই ভিটামিন পাওয়া যায় । বাঁধাকপি, ফুলকপি, পালং এইসব শাক-সবজিতে ভিটামিন B1 পাওয়া যায় ।

ঘাটতির ফল –   ভিটামিন B1 (Thiamine) এর ঘাটতির ফলে বেরীবেরী রোগ হয় । এছাড়া ওজন কমে যাওয়ার প্রবনতা দেখা যায় । Wernicke-Korsakoff এর লক্ষণ thiamine  এর অভাবে দেখা যায় ।

ভিটামিন B2 – কার্যকারীতা এবং উৎস (Source and Function of Vitamin B2)

ভিটামিন B2 একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন যার রাসায়নিক নাম Riboflavin । ভিটামিন B কমপ্লেক্স অন্তর্ভুক্ত একটি ভিটামিন মানবদেহে যার ঘাটতি সাধারনত অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাপনের ফলে হয় ।

প্রয়োজনীয়তা –  ভিটামিন B2 macronutrients অর্থাৎ প্রোটিন, ফ্যাট এবং কার্বহাইড্রেটকে শক্তিতে রুপান্তর করতে সাহায্য করে । এছাড়া ত্বক, স্নায়ু, মাংসপেশি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে ।

উৎস – লেটুস, অ্যাসপারাগাস, পালং, ব্রোকলি, মটরশুঁটি এইধরনের শাকসবজি ভিটামিন B2 এর উৎস । এছাড়া ডিম, পোল্ট্রি, মাছ, দুধ, দই, চীজ এইসব খাওয়ার থেকে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন B2 পাওয়া যায় ।

Green Peas – source of vitamin B2

ঘাটতির ফল – ভিটামিন B2 (Riboflavin) এর ঘাটতির ফলে শুষ্ক ত্বক, ঠোঁট ফাটা, গলায় ঘা, মুখে ঘা, জিভে ঘা এই ধরনের সমস্যা দেখা যায় । এছাড়া ভিটামিন B2 এর ঘাটতির ফলে অ্যানিমিয়া হওয়ার প্রবনতা বাড়ে ।

ভিটামিন B3 – উৎস এবং কার্যকারীতা (Source and Function of Vitamin B3)

ভিটামিন B কমপ্লেক্সের অন্তর্গত একটি ভিটামিন যা নিয়াসিন নামে পরিচিত । অন্যান্য B ভিটামিনের মত এটিও একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন ।

প্রয়োজনীয়তা – ত্বক, স্নায়ু এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশের জন্য নিয়াসিন একটি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করে । এছাড়া বেশ কিছু গবেষনায় দেখা গেছে নিয়মিত ভিটামিন B3 সম্বলিত খাদ্য গ্রহনে খারাপ কোলেস্টেরল (LDL or Low Density Lipoproteins) কমায় এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL or High Density Lipoproteins) বাড়ায় ।

উৎস – ভিটামিন B3 যেসব খাওয়ারে পাওয়া যায় সেগুলি হল আলু, আদা, মাশরুম, বেল পেপার, অ্যাভোকাডো, মটরশুঁটি, কুমড়োর দানা, সুর্যমুখীর দানা, বিনস, শাক ইত্যাদি । এছাড়া দুধ, চীজ, দই, ওটস, পাস্তা, পাউরুটি এতেও ভিটামিন B3 প্রচুর পরিমানে পাওয়া যায় । প্রাণীজ উৎসগুলো হল স্যালমন, টুনা, ডিম, পোল্ট্রি ইত্যাদি ।

ঘাটতির ফল – ভিটামিন B3 এর অভাবে পেলেগ্রা (Pellagra) রোগ হয় যাতে ডাইরিয়া, হাইপারপিগমেন্টেশন, চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া, মুখ ও গলায় ঘা এই ধরনের লক্ষণ দেখা যায় । এছাড়া খাওয়ারে ভিটামিন B3  এর অভাবের ফলে শরীরে ক্লান্তি এবং দুর্বলতা দেখা যায় ।  

ভিটামিন B5 – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin B5)

ভিটামিন B5 একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন যা ভিটামিন B  কমপ্লেক্স অন্তর্ভুক্ত একটি ভিটামিন । এটি Pantothenic Acid নামেও পরিচিত । ভিটামিন B5 প্রায় সবরকম খাদ্যে পাওয়া যায় ।

প্রয়োজনীয়তা – বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি রূপান্তরের ক্ষেত্রে ভিটামিন B5 গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । এছাড়া রক্তের শর্করার স্তর সঠিক রাখা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, অনিদ্রা এইধরনের সমস্যা সমাধানে ভিটামিন B5 সাহায্য করে ।

উৎস – যেসব শাক-সবজিতে ভিটামিন B5 পাওয়া যায় সেগুলি হল ব্রোকলি, মিষ্টি আলু, ভুট্টা, ফুলকপি, মাশরুম, অ্যাভোকাডো, টমেটো ইত্যাদি । এছাড়া দুধ, দই, ডিমের কুসুম, পোলট্রি এতেও ভিটামিন B5 পাওয়া যায় ।

Brocolli-Cauliflower source of vitamin B5

ঘাটতির ফল – ভিটামিন B5 এর ঘাটতির ফলে বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব ঘটে, যার ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা এইধরনের সাধারন সমস্যা দেখা যায় । এছাড়া শরীরে শর্করার পরিমান কমে যায় যাতে শরীরে শর্করার সাম্যতা হারিয়ে ফেলে ।  

ভিটামিন B6 – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin B6)

ভিটামিন B6 যা পাইরিডোক্সাইন নামেও পরিচিত । এটি একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন, যা মস্তিষ্ক বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে ।

প্রয়োজনীয়তা – মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর বৃদ্ধি, বিকাশ এবং কাজ করার ক্ষেত্রে ভিটামিন B6 খুব প্রয়োজন । এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশ, মেজাজ নিয়ন্ত্রন, বিষন্নতার থেকে মুক্তি এইধরনের উপকার ভিটামিন B6 গ্রহনের ফলে পাওয়া যায় ।

উৎস – যেসব সবজি এবং ফলে ভিটামিন B6 পাওয়া যায় সেগুলো হল আলু, মিষ্টি আলু, উচ্ছে, করলা, অ্যাভোকাডো, গাজর, পালং, কলা, পেপে, কমলালেবু ইত্যাদি । এছাড়া দুধ, ডিম, পোলট্রি, স্যালমন, টুনা, ম্যাকারেল, ছোলা, সোয়াবিন এতেও ভিটামিন B6 পাওয়া যায় ।

ঘাটতির ফল – ভিটামিন B6  এর ঘাটতির ফলে মাইক্রোসাইটিক অ্যানিমিয়া হয় । এছাড়া হঠাৎ মেজাজ পরিবর্তন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, অল্পেতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়া এইধরনের কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ।

ভিটামিন B7 – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin B7)

ভিটামিন B7, ভিটামিন B কমপ্লেক্স পরিবারের একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন যা Biotin নামেও পরিচিত । এছাড়া এটি ভিটামিন H নামেও পরিচিত, যেখানে ‘H’  শব্দটি জার্মান ভাষায় ‘Haar and Haut’ যার অর্থ ‘চুল এবং ত্বক (Hair and Skin)’ ।

প্রয়োজনীয়তা – বায়োটিন চুল, নখ এবং ত্বকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । চুল মজবুত করে, চুল পড়া কমায় । নখ এবং চামড়ার গঠন উন্নত করে । এছাড়া বিভিন্ন চর্মরোগ প্রতিরোধ করে ।

উৎস – ডিমের কুসুম ভিটামিন B7 এর একটি ভালো উৎস । এছাড়া ব্রোকলি, পালং, গাজর, মাশরুম, মিষ্টি আলু, কলা, অ্যাভোকাডো এই ধরনের শাক-সবজি এবং ফলে ভিটামিন B7 পাওয়া যায় । এছাড়া বাদাম, সুর্যমুখী দানা এতেও যথেষ্ট পরিমানে ভিটামিন B7 পাওয়া যায় ।

Egg Yolk-source of vitamin B7

ঘাটতির ফল – যদিও শরীরে biotin এর ঘাটতি বিরল ঘটনা, তবুও biotin এর অভাবে চুল পড়া, শুষ্ক ভঙ্গুর নখ, খসখসে চামড়া, জিভে ঘা এই ধরনের সমস্যা দেখা যায় ।

ভিটামিন B9 – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin B9)

ভিটামিন B9 একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন যা ভিটামিন B কমপ্লেক্স পরিবার অন্তর্ভুক্ত । এটি Folate নামেও পরিচিত, যা মূলত সবুজ পাতা যুক্ত সবজি এবং শাকে পাওয়া যায় ।

প্রয়োজনীয়তা – অন্যান্য B ভিটামিনের মত এটিও খাদ্যে প্রাপ্ত কার্বহাইড্রেটকে তুলনামূলক সহজ এবং সরল পাচনযোগ্য গ্লুকোজে পরিনত করে, যা প্রয়োজনীয় শক্তিতে রূপান্তর করে । এছাড়া লোহিত রক্ত কনিকা তৈরীতে ভিটামিন B9 গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । এবং মানবদেহের বিকাশের সময় যেমন গর্ভাবস্থায়, শৈশবে মানবদেহের কোষের বৃদ্ধি এবং নতুন কোষ তৈরীতে সাহায্য করে ।

উৎস – যেসব খাদ্যে ভিটামিন B9 পর্যাপ্ত পরিমানে পাওয়া যায় সেগুলি হল পালং, অ্যাসপারাগাস, ব্রোকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, বিট, আলু, মটরশুঁটি, বিনস, মসুর ডাল, অ্যাভোকাডো, পেঁপে, কমলালেবু ইত্যাদি । এছাড়া চিনাবাদাম, ডিমের কুসুম, দুধ এতেও ভিটামিন B9 পাওয়া যায় ।

ঘাটতির ফল – সাধারনত এর ঘাটতি মানবদেহে হয় না, কিন্তু যারা মদ্যপানে আসক্ত তাদের শরীরে folate  এর ঘাটতি হয় । কারন তাদের শরীরে folate সহজে শোষিত হয় না এবং যেহেতু এটি একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন তাই খুব সহজেই শরীর থেকে বেরিয়ে যায় ।

এছাড়াও ভিটামিন B9 বা  folate এর ঘাটতির ফলে সবথেকে লক্ষণীয় যে সমস্যাটা দেখা যায় সেটি হল অ্যানিমিয়া । বিশেষত গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যে এর সম্ভাবনা বেশী থাকে ।

ভিটামিন B12 – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin B12)

ভিটামিন B12 যা ভিটামিন B কমপ্লেক্স পরিবারের শেষ ভিটামিন । অন্যান্য B ভিটামিনের মত এটিও জলে দ্রবনীয় ভিটামিন যার রাসায়নিক নাম Cobalamin, তবে ভিটামিন B12 বেশকিছুদিন মানবদেহে সঞ্চিত থাকতে পারে । এটি মানবদেহের DNA সংশ্লেষ, অ্যামিনো অ্যাসিড বিপাক এবং ফ্যাটি অ্যা সিড সংশ্লেষে সাহায্য করে ।

প্রয়োজনীয়তা – মস্তিষ্কের গঠন, বিকাশ এবং যথাযথ কর্মক্ষম করে তুলতে সাহায্য করে । এছাড়া কোষ বিভাজন, DNA গঠন, লোহিত রক্ত কনিকা তৈরী করতে এই ভিটামিন সাহায্য করে ।

উৎস – দুধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য যেমন দই, চীজ, মাছ, ডিম, পোলট্রি, সোয়াজাত দ্রব্য এবং বিভিন্ন দানাশস্য ভিটামিন B12 এর ভালো উৎস ।

Cheese – source of vitamin B12

ঘাটতির ফল – হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের অভাবের কারনের নিরামিষাশীদের মধ্যে ভিটামিন B12 এর ঘাটতি দেখা যায় । এছাড়া Cobalamin এর অভাবে বিভিন্ন ধরনের অ্যানিমিয়া হয় যার লক্ষণগুলি হল দুর্বলতা, ক্লান্তি, স্নায়ুক্ষয়, দ্রুত শ্বাস প্রশ্বাস, দ্রুত হৃদস্পন্দন ইত্যাদি ।

ভিটামিন C – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin C)

ভিটামিন C একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন যার রাসায়নিক নাম Ascorbic Acid । মানবদেহের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার জন্য এই ভিটামিন খুব গুরুত্বপুর্ণ, যেমন সর্দি-কাশি প্রতিরোধ একটি প্রক্রিয়া । ভিটামিন C বেশ কিছু প্রাণীর শরীরে সংশ্লেষিত হয়, কিন্তু মানবদেহে এটি সংশ্লেষিত হয় না । তাই আমাদের খাদ্যের মাধ্যমে ভিটামিন C গ্রহন করতে হয় ।

প্রয়োজনীয়তা – আমরা সবাই জানি সুস্থ ত্বকের জন্য ভিটামিন C এক অনবদ্য উপাদান । ত্বকের যেকোনো সমস্যার জন্য ভিটামিন C উপকার করে । ক্ষত নিরাময় এবং কোলাজেন সংশ্লেষের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনেক, কারন ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাদ্যসামগ্রী কোলাজেন তৈরী করে । স্কার্ভি প্রতিরোধ এবং সারিয়ে তুলতেও ভিটামিন C কাজে লাগে । এছাড়া যেসব রোগ সারিয়ে তোলার ক্ষেত্রে ভিটামিন C প্রচন্ড উপকারী সেগুলি হল Bronchitis, Asthma, মাড়ির অসুখ ইত্যাদি ।

উৎস –  যেসব সবজি এবং ফল যা অতি সহজেই ভিটামিন C এর ঘাটতি মেটাতে পারে সেগুলি হল ব্রোকলি, আলু, ফুলকপি, টমেটো, বাঁধাকপি, পালংশাক, ক্যাপসিকাম, ধনেপাতা, স্ট্রবেরী, পেঁপে, আম, আনারস, পেয়ারা, পাতিলেবু, কমলালেবু, ব্লাকবেরি ইত্যাদি ।

ঘাটতির ফল – ভিটামিন  C  এর অভাবে কোলাজিন প্রোটিন উৎপাদন কমে যায়, যার ফলে ক্ষত নিরাময় বিলম্বিত হয়, চামড়া শুষ্ক, শুকনো হয়ে যায় । এছাড়া ভিটামিন C  এর ঘাটতির ফলে স্কার্ভি হয় । ভিটামিন  C, আমাদের শরীরে iron শোষণে সাহায্য করে । তাই ভিটামিন C এর ঘাটতির পরোক্ষ ফল অ্যানিমিয়া  ।

ভিটামিন D – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin D)

ভিটামিন D একমাত্র ভিটামিন যার মূল উৎস সুর্যালোক । এটি একটি চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিন, যা সহজেই আমাদের শরীরে জমা হয় ।

প্রয়োজনীয়তা – ক্যালসিয়াম একটি ম্যাক্রোমিনারেল যার উপর আমাদের হাড়ের স্বাস্থ্য নির্ভর করে । ভিটামিন D আমাদের শরীরে ক্যালসিয়াম শোষনে সাহায্য করে, যার ফলে আমাদের হাড় সুস্থ থাকে এবং সহজে হাড় ভেঙে যাওয়া, চিড় ধরা প্রতিরোধ করে । এছাড়া স্থুলতা কমিয়ে শরীরের ওজনের সাম্যতা বজায় রাখতে ভিটামিন D সাহায্য করে ।

উৎস – সুর্যালোক হল ভিটামিন D এর সবথেকে ভালো উৎস । এছাড়া যেসব খাদ্যের মাধ্যমে আমরা ভিটামিন D পেতে পারি সেগুলি হল মাশরুম, ওটস, গরুর দুধ, সোয়ামিল্ক, কমলালেবুর রস, বাদাম, ডিমের কুসুম, কড লিভার তেল, স্যালমন, টুনা ইত্যাদি ।

Salmon- source of vitamin D

ঘাটতির ফল – ভিটামিন D আমাদের হাড় এবং দাঁতের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় । এই ভিটামিনের ঘাটতির ফলে রিকেট (Ricket), অস্টিওম্যালেসিয়া (Osteomalacia) এবং অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis) এর মত অসুখ দেখা যায় ।

ভিটামিন E – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin E)

ভিটামিন E একটি চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিন যা আমাদের জন্য প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । এটি আমরা সাধারন খাদ্য এবং পরিপূরকের মাধ্যমে পেয়ে থাকি ।

প্রয়োজনীয়তা – মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য এই ভিটামিন খুব প্রয়োজন । ভিটামিন E একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরের কোষসমূহকে আঘাত থেকে রক্ষা করে ।

উৎস – পালংশাক, ব্রোকলি, টমেটো, জলপাই, অ্যাভোকাডো, বেল পেপার, আম, বাদাম, মার্জারিন, সুর্যমুখী তেল, সোয়াবিন তেল এইসব খাওয়ারে ভিটামিন E উপযুক্ত পরিমানে পাওয়া যায় ।

ঘাটতির ফল – হিমোলিটিক অ্যানিমিয়া, যা সাধারনত সদ্যজাত শিশুদের মধ্যে দেখা যায় । এছাড়া মাংসপেশির সমস্যা যেমন মায়োপ্যাথি (পেশি তন্ত সঠিকভাবে কাজ না করা), চোখের সমস্যা যেমন রেটিনোপ্যাথির মত অসুখ ভিটামিন E এর ঘাটতির ফলে হয় ।

ভিটামিন K – উৎস এবং কার্যকারীতা  (Source and Function of Vitamin K)

ভিটামিন K  একটি অপরিহার্য চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিন, যা আমাদের শরীরে ‘প্রথ্রোমবিন’ তৈরী করে । প্রথ্রোমবিন রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে ।

প্রয়োজনীয়তা – বাহ্যিক আঘাত নিরাময় এবং রক্ত তরলীকরণের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভিটামিন K মুখ্য ভূমিকা নেয় । এছাড়া হাড়ের উন্নত স্বাস্থ্যর জন্য ভিটামিন K প্রয়োজন ।

উৎস – ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রোকলি, লেটুস, ধনেপাতা, পালংশাক, অ্যাভোকাডো, দুধ, দই, চীজ, ডিম ভিটামিন K সমৃদ্ধ খাদ্য যা ভিটামিন K এর ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করে ।

Parsley – source of vitamin K

ঘাটতির ফল – যদিও খুবই বিরল ঘটনা, তবুও কিছু নির্দিস্ট পরিস্থিতি যেমন দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে ভিটামিন K শোষন করার ক্ষমতা কমে যায় । এরকম পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ধরনের রক্তক্ষরনের সমস্যা যেমন মূত্রে রক্ত, নাক মুখ দিয়ে রক্তক্ষরন এইধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ।

সারমর্ম

উপরে আমরা বিভিন্ন ধরনের ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা, সেইসব ভিটামিন সম্বলিত খাদ্য এবং ঘাটতির ফলে কি সমস্যা হতে পারে আলোচনা করলাম । যেসব সহজলভ্য শাক-সবজি বা ফল খাওয়ার মাধ্যমে আপনি সবধরনের ভিটামিন পেতে পারেন, তা আপনি জানতে পারলেন । মনে রাখবেন, সবথেকে সুরক্ষিত এবং সহজ উপায় আমাদের শরীরকে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান যোগান দেওয়ার সেগুলি হল শাক-সবজি এবং ফল বা প্রাণীজ উপাদান । বাজারজাত পরিপূরক গ্রহনের আগে অবশ্যই চিকিৎসক বা অভিজ্ঞ নিউট্রিশনিস্টের পরামর্শ নেওয়া একান্ত প্রয়োজনীয় ।

যদি, এই সংক্রান্ত আপনাদের কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে, তাহলে অবশ্যই আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানান । আপনি চাইলে আমাদের সঙ্গে email এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন । ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং অন্যকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করুন ।    

How useful was this post?

1
San

Recent Posts

মেডিটেশনের খারাপ প্রভাব (Adverse Effect of Meditation)

আমরা সাধারনত একটা কথা বলে থাকি যে কোনোকিছুই অতিরিক্ত ভালো না । এই একই কথা…

2 months ago

প্রতিদিন যোগাভ্যাসের উপকারীতা (Benefits of Practicing Yoga for Everyday)

শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই একটি বহুল প্রচলিত অভ্যাসের নাম হল “যোগ”…

2 months ago

মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব (Importance of Mental and Physical Health)

‘স্বাস্থ্য’  কথাটা শুনলে আমরা সাধারনভাবে শুধু শরীরের কথাই ভেবেথাকি, ঠিক পদ্ধতিতে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের…

8 months ago

ডাল – প্রোটিনের উৎস (Lentils – Protein Source)

প্রাচীনকাল থেকে যেসকল কৃষিজ শষ্য মানবজাতির কাছে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে  তার মধ্যে ডাল (Lens…

1 year ago

নিরামিষাশীদের জন্য প্রোটিনের উৎস (Veg Protein Sources)

সূচনা (Introduction) প্রোটিন (Protein) একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রোনিইট্রিয়েন্ট (Macronutrient)  যার উৎস (protein sources) আমাদের প্রতিদিনের গ্রহন…

2 years ago

প্ল্যাঙ্ক (Plank Pose) – পদ্ধতি, উপকারীতা

যোগাভ্যাসের বিভিন্ন ধরনের আসন, যা আমাদের দেহের নীচের অংশ যেমন পা, কোমর পেট এবং পিঠ…

2 years ago