dirga-pranayama

দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama) বা তিন – ধাপ প্রানায়ম

দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama)  বা তিন-ধাপ প্রানায়ম সবথেকে কার্যকরী নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকার্য যা অভ্যাসের ফলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমান বৃদ্ধি পায় এবং রক্ত চলাচলের মাধ্যমে শরীরের সমস্ত অংশে অক্সিজেন পৌছয় । দির্গা প্রানায়ম তিনটি ধাপে অভ্যাস করা যায় যেখানে পেট, মধ্যচ্ছদা এবং ফুসফুস নিযুক্ত হয় ।

এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে অভ্যাসকারীর মনোযোগ বৃদ্ধি হয়, যেকারনে যোগ-ব্যায়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেকসময় প্রশিক্ষা পর্ব শুরুর আগে প্রশিক্ষার্থীদের এই প্রানায়ম অভ্যাস করানো হয় । এতে শুধুমাত্র শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রিত হয় এমন নয় । যোগ অভ্যাসের জন্য যে মনোসংযোগ প্রয়োজন তা এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে আয়ত্ত হয় ।

দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama) কি?

এটি একটি অতীব কার্যকরী শ্বাসকার্য অনুশীলন যা অভ্যাসের ফলে অভ্যাসকারীর শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রিত এবং সঠিক পদ্ধতি অবলম্বন করে । এছাড়া এই অভ্যাসের ফলে বায়ু অভ্যাসকারীর পেট অবধি পৌছয় এবং সমগ্র শরীরে প্রচুর পরিমানে অক্সিজেযুক্ত রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায় ।

‘পতঞ্জলি যোগসূত্রে’ এই প্রানায়ম ‘দির্গা শ্বাসম প্রানায়ম’ নামে পরিচিত, যেখানে ‘দির্গা’ (একটি সংস্কৃত শব্দ) কথাটির অর্থ ‘সম্পূর্ণ’ বা ‘ধীর’ বা ‘গভীর’ বা ‘দীর্ঘ’ এবং ‘শ্বাসম’ কথাটির অর্থ ‘শ্বাসকার্য’ । এইকারনে এই দির্গা প্রানায়ম অনেকস্থানে ‘সম্পূর্ণ শ্বাস-প্রশ্বাস’ নামেও পরিচিত ।

দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama) অভ্যাসের পদ্ধতি

নীচে উল্লেখিত পদ্ধতিগুলি অনুসরনের মাধ্যমে দির্গা প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে ।

১) তিন-ধাপ প্রানায়ম বা দির্গা প্রানায়ম অভ্যাস যেকোন আরামদায়ম ভাবে করা যেতে পারে, শুধু খেয়াল রাখতে হবে যাতে মেরুদন্ড সোজা থাকে এবং পেট কোনোভাবেই সংকুচিত না থাকে । এই প্রানায়ম অভ্যাস মেঝেতে সুখাসনে অর্থাৎ দুই পা সাধারনভাবে ভাঁজ করে বসে বা চেয়ারে সামনের দিকে এগিয়ে বসে আবার শুয়েও অভ্যাস করা যেতে পারে । অভ্যাসকারী নিজের সুবিধামত অবস্থান ঠিক করে নিতে পারে ।

২) যারা শুয়ে অভ্যাস করাই পছন্দ করবে তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে পিঠ সোজা থাকে, চোখ বন্ধ এবং সমগ্র শরীর এবং মুখ স্বচ্ছন্দ থাকে । শুয়ে দুই পা সোজা রেখে অথবা হাঁটু ভাঁজ করে শুইয়ে অভ্যাস করতে পারে । যারা চেয়ারে বসে অভ্যাস করতে স্বচ্ছন্দ অনুভব করবে তাদের খেয়াল রাখতে হবে যাতে দুই পায়ের পাতা মাটি স্পর্শ করে থাকে ।

৩) চেয়ারে বা মেঝেতে বসে অভ্যাসের ক্ষেত্রে হাতদুটি দুই হাটুঁর উপর আরামদায়ক ভাবে রেখে বসতে পারে এবং শুয়ে অভ্যাসের ক্ষেত্রে হাতদুটি শরীরের দুই পাশে আরামদায়কভাবে রাখতে পারে ।

দির্গা প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে অভ্যাসকারীর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ অনুভব করা সর্বাগ্রে প্রয়োজন

৪) আরামদায়ক অবস্থানে বসে বা শুয়ে কিছুক্ষণ নিজের শ্বাস প্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যা মানসিক স্থিতীশীলতা প্রদান করবে এবং পরবর্তী পদ্ধতিগুলি করতে সাহায্য করবে । পর্যবেক্ষনের সময় কোনোকিছু পরিবর্তন করার বা আলাদা করে কোনোকিছু অভ্যাসের কোনো প্রয়োজন নেই, তাতে মনোযোগ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় । এইসময় নানারকম চিন্তা-ভাবনা মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, কিন্তু তাতে উত্যক্ত না হয়ে স্থির মস্তিষ্কে সেগুলি এড়িয়ে গিয়ে নিজের চিন্তা-ভাবনা শ্বাস প্রশ্বাসের প্রতি নিবদ্ধ করতে হবে । 

৫) এবারে নাকের সাহায্যে শ্বাস টানতে হবে এবং টানার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে বাতাস পেটে যায় । নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী বাতাস টেনে পেট ভর্তি করতে হবে । শ্বাস টানা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে পেট থেকে আস্তে আস্তে বাতাস নাকের মাধ্যমে ছাড়তে হবে । সম্পূর্ণ বাতাস নাকের মাধ্যমে ছাড়ার ফলে পেট একেবারে ভিতরের দিকে ঢুকে যাবে । এইভাবে ৫ বার শ্বাস টানা এবং ছাড়া সম্পূর্ণ করতে হবে এবং এটা হল এই প্রানায়মের প্রথম ধাপ । 

দির্গা প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে শ্বাস ধরে রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই

৬) পরবর্তি ধাপে শ্বাস নাকের মাধ্যমে টানার সময় পেট সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে যাওয়ার পরে আরও কিছুটা শ্বাস টানতে হবে এবং সেই বাতাস ফুসফুসে পৌছয় এবং এর ফলে ফুসফুস প্রসারিত হবে । শ্বাস ছাড়ার সময় প্রথমে ফুসফুস থেকে বাতাস বের করতে হবে যাতে ফুসফুস সংকুচিত হয় । এরপরে পেট থেকে বাতাস বের করতে হবে যাতে পেট ভিতরের দিকে অর্থাৎ মেরুদন্ডের দিকে ঢুকে যায় । এইভাবে ৫ বার এই পদ্ধতি সম্পূর্ণ করার ফলে দ্বিতীয় ধাপ সম্পূর্ণ হবে ।

RELATED : BASICS OF PRANAYAMA

৭) তৃতীয় এবং সর্বশেষ ধাপে একই পদ্ধতিতে নাকের মাধ্যমে শ্বাস টেনে প্রথমে পেট ভর্তি করতে হবে যাতে পেট সম্পূর্ণ প্রসারিত হয় । তার পরে আরও একটু শ্বাস টেনে ফুসফুস ভর্তি করতে হবে যাতে ফুসফুস প্রসারিত হয় । এরপরে আরও একটু শ্বাস টেনে ফুসফুসের উপরিভাগ অর্থাৎ বুকের উপরদিক এমনভাবে ভর্তি করার চেষ্টা করতে হবে যাতে কন্ঠাস্থির উপর চাপ অনুভূত হয় ।

এবারে শ্বাস ছাড়ার সময় প্রথমে বুকের উপরিভাগ থেকে শ্বাস ছাড়তে হবে যাতে উপরিভাগের চাপ কমে, এরপরে ফুসফুস থেকে শ্বাস ছেড়ে ফুসফুস সংকুচিত করতে হবে । সবশেষে পেট থেকে শ্বাস ছাড়তে হবে যাতে পেট ভিতরের দিকে ঢুকে যায় । এইভাবে ১০ বার অভ্যাস করতে হবে ।

8) এই প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যাতে প্রতিটা ধাপের মধ্যে কোনোরকম বিরতি না থাকে । তিনটি ধাপ সম্পূর্ণ হওয়ার পরে কিছুক্ষণ স্বাভাবিক শ্বাসকার্য করে স্থান পরিবর্তন করা যেতে পারে অথবা পরবর্তি অনুশীলন শুরু করা যেতে পারে ।

উপকারীতা

এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে গভীর এবং সম্পূর্ণ শ্বাসকার্য করার ক্ষমতা তৈরী হয় । আমরা সাধারনত যেভাবে শ্বাসকার্য করে থাকি তাতে ফুসফুসের উপরিভাবে অক্সিজেন পৌছয় কিন্তু ফুসফুসের নিম্নভাগে খুব কম পরিমানে অক্সিজেন পৌছতে পারে । যার ফলে রক্তে উপযুক্ত পরিমান অক্সিজেন সরবরাহ হয় না । এছাড়া অগভীর শ্বাসকার্য ফুসফুস এবং হৃদযন্ত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করে ।

দির্গা প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে গভীরভাবে শ্বাসকার্য করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় যার ফলে শরীরের প্রতিটা অংশে উপযুক্ত পরিমানে অক্সিজেন পৌছয় । গবেষণায় দেখা গেছে একবার দির্গা প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে স্বাভাবিকের তুলনায় সাতগুন বেশী অক্সিজেন শরীরে পৌছয় । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায় এবং উত্তেজনা বা মানসিক পীড়ন কমে ।

এছাড়াও এই প্রানায়ম অনেকসময় মেডিটেশন অভ্যাসের ভীত হিসেবে ব্যাবহৃত হয় কিন্তু এর অভ্যাসের ফলে মনোযোগ বৃদ্ধি বা সচেতনতা বৃদ্ধির মত সুফল পাওয়া যায় ।

সতর্কতা

অন্যান্য সব প্রানায়ম অভ্যাসের মত এই প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রেও লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে খাওয়ার পরে অন্তত ৩-৪ ঘন্টা তফাৎ থাকে । তবে খালিপেটে অভ্যাস করতে পারলে সবথেকে ভালো । যাদের শ্বাসজনিত কোনো সমস্যা যেমন অ্যাস্থমা আছে তাদের উচিৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এই অভ্যাস করা উচিৎ । দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama) অভ্যাসকালীন কোনোরকম ক্লান্তি বা মাথাধরা অনুভব করলে তৎক্ষণাৎ অভ্যাস বন্ধ করে দিতে হবে । কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে তারপরে আবার শুরু করা যেতে পারে ।

সারমর্ম

সাধারনত যোগ-প্রশিক্ষনের শুরুতে এবং শেষে এই প্রানায়ম অভ্যাস করা হয়, তবে শুধু প্রানায়ম অভ্যাসের জন্যও এই দির্গা প্রানায়ম (Dirga Pranayama) অভ্যাস করা যেতে পারে । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে অনেক বেশী তরতাজা এবং উজ্জীবিত মনে হবে । ফুসফুসের উপর কোনোভাবেই অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করার প্রয়োজন নেই । নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী এই প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে ।

দির্গা প্রানায়মের সুফল উপভোগ করার জন্য উপরে বর্ণিত পদ্ধতিগুলি অনুসরণ করে আপনিও এই প্রানায়ম অভ্যাস শুরু করতে পারেন । দির্গা প্রানায়ম সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে নীচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন । ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ।

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।         

How useful was this post?

Click on a star to rate it!

We are sorry that this post was not useful for you!

Let us improve this post!

Tell us how we can improve this post?

Leave a Reply

Scroll to Top