সুর্য্য-ভেদী প্রানায়ম (surya bhedi pranayama) বা ডান-নাসারন্ধ্র প্রানায়ম একটি নিয়ন্ত্রিত শ্বাসকার্য অভ্যাস, হটযোগ মতানুসারে যা অন্যতম উপকারী যোগ পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত । এই প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ডান নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস টানা হয় এবং বাম নাসারন্ধ্র দিয়ে শ্বাস ছাড়া হয় ।
আয়ুর্বেদ অনুসারে আমাদের দুটি নাসারন্ধ্র দুটি নাড়ির প্রতিনিধিত্ব করে । ডান নাড়ি ‘পিঙ্গলা’ যা সুর্য্যের সহযোগী এবং বাম নাড়ি ‘ইড়া’ যা চন্দ্রের সহযোগী । যেহেতু এই প্রানায়ম অভ্যাসের সময় শুধু মাত্র ডান নাসারন্ধ্রের মাধ্যমে শ্বাস টানা হয় তাই একে সুর্য্য-ভেদী প্রানায়ম (surya bhedi pranayama) বা সুর্য্য ভেদন প্রানায়ম বলা হয় ।
সুর্য্য-ভেদী প্রানায়ম একটি সহজ এবং কার্যকরী শ্বাসকার্য পদ্ধতি যা ‘হটযোগ প্রদীপিকা’ এবং ‘ঘেরান্ডা সংহিতা’ পুস্তিকায় উল্লেখিত ৮টি প্রানায়ম পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম । নিয়মিত সুর্য্য-ভেদী প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শরীরের আভ্যন্তরীন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, ইচ্ছাশক্তির বৃদ্ধি হয় এবং কাজে উৎসাহ বাড়ে ।
Table of Contents
যেকোনো প্রানায়ম অভ্যাসের জন্য কিছু সাধারন নিয়ম থাকে, যেমন খোলামেলা পরিচ্ছন্ন স্থান, তুলনামূলক শান্ত পরিবেশ ইত্যাদি । এছাড়া প্রানায়ম অভ্যাসের সবথেকে ভালো সময় হল সকাল অথবা সন্ধ্যা অর্থাৎ যখন খাওয়ার পরে বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে যায় । কারন খালিপেটে অথবা খাওয়ার অন্তত ৪ ঘন্টা পরে প্রানায়ম অভ্যাস করা উচিৎ ।
মেঝেতে অথবা চেয়ারে বসে প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে, তবে মেঝেতে বসে অভ্যাস করাই সবথেকে ভালো । যাদের পক্ষে মেঝেতে বসা সম্ভব নয়, তারা চেয়ারে বসেই অভ্যাস করতে পারেন, এবং তাতে কোনো সমস্যা নেই । বসার সময় লক্ষ্য রাখবেন যাতে মেরুদন্ড এবং ঘাড় সোজা থাকে । মেঝেতে বসে পিঠ সোজা রাখতে অসুবিধা হলে কুশন বা কম্বলের ব্যাবহার করা যেতে পারে । যারা চেয়ারে বসে অভ্যাস করবেন, তারা খেয়াল রাখবেন যাতে পায়ের পাতা দুটি মাটি স্পর্শ করে থাকে ।
এগুলি যেকোনো প্রানায়ম অভ্যাসের সাধারন কিছু নিয়ম যা আমাদের মনে রাখতে হবে । বিভিন্ন প্রকারের প্রানায়মের কিছু ভিন্ন পদ্ধতি আছে যেগুলি একে অপরের থেকে আলাদা করে তোলে ।
১) সর্বপ্রথম হাতের অবস্থান সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার । ডানহাত অথবা বামহাত যে হাতে স্বচ্ছন্দ সেইহাতের সাহায্যেই অভ্যাস করা যেতে পারে । উদাহরন হিসেবে ডানহাত বিষ্ণু-মুদ্রা ভঙ্গীতে করুন এবং বামহাত জ্ঞান-মুদ্রায় করে বাম হাঁটুর উপর রাখুন । যারা বামহাতে স্বচ্ছন্দ তারা উল্টোটাও করতে পারেন এবং তাতে কোনো অসুবিধা নেই ।
২) আগেই বলেছি যে এই প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা শুধু ডান নাসারন্ধ্রের সাহায্যে শ্বাস টানব এবং বাম নাসারন্ধ্রের সাহায্যে শ্বাস ছাড়ব । ডান নাসারন্ধ্র বন্ধ করার জন্য ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান নাকের উপর হালকা চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং বাম নাসারন্ধ্র বন্ধ করার জন্য ডান হাতের অনামিকা এবং কনিষ্ঠার সাহায্যে বাম নাকের উপর হালকা চাপ প্রয়োগ করতে হবে ।
৩) চোখ বন্ধ করে আরামদায়ক ভাবে উপরের নির্দেশমত বাম নাকের উপর চাপ প্রয়োগ করে বাম নাসারন্ধ্র বন্ধ করে ডান নাক দিয়ে আস্তে আস্তে এবং গভীরভাবে শ্বাস টানুন । শ্বাস টানার সময় খেয়াল রাখবেন যাতে কোনো রকম বল প্রয়োগ করতে না হয় । যতটা সম্ভব স্বচ্ছন্দ গতিতে শ্বাস টানুন ।
৪) যারা প্রাথমিকভাবে শুরু করছেন তাদের জন্য এই প্রানায়ম খুবই কার্যকরী, কিন্তু প্রথমেই শ্বাস ধরে রাখার প্রয়োজন নেই । আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে গেলে শ্বাস টেনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধরে রাখতে পারেন । এতে বেশী লাভ পাওয়া যায় ।
৫) এবারে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সাহায্যে ডান নাক বন্ধ করে খুব ধীর গতিতে বাম নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ুন । শ্বাস টানার সময় বা ছাড়ার সময় কোনো খেয়াল রাখবেন শরীরের উপর যাতে কোনো চাপ না পড়ে ।
৬) যারা একদম প্রাথমিক স্তরে প্রানায়ম শুরু করতে চলেছেন তাদের জন্য এই প্রানায়ম একটি ভালো বিকল্প । প্রথম প্রথম শুধু শ্বাস টানা এবং ছাড়ার দিকেই লক্ষ্য রাখুন । যেমন ১ সেকেন্ড ধরে শ্বাস টেনে আবার ১ সেকেন্ড সময় নিয়ে শ্বাস ছাড়ুন । ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠলে সময় বাড়াতে পারেন এবং শ্বাস ধরে রাখার ব্যাপারটাও অন্তর্গত করে নিতে পারেন । যেমন ১ সেকেন্ড ধরে শ্বাস টেনে ৪ সেকেন্ড শ্বাস ধরে রাখুন এবং ২ সেকেন্ড সময় নিয়ে শ্বাস ছাড়ুন ।
প্রথম প্রথম ৫ থেকে ১০ বার অভ্যাস করতে পারেন, কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে উঠলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট অবধি অভ্যাস করা যেতে পারে । উপরে যে সময়ের হিসেব দেওয়া হয়েছে সেটি একটি উদাহরনমাত্র । অভ্যাস করার সময় নিজের সুবিধা মত ঠিক করে নিতে হবে সময়সীমা ।
এই প্রানায়ম অভ্যাসের পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা জানলাম । এবার চলুন জেনে নিই, এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে কোন ধরনের লাভ আমরা পেতে পারি ।
এছাড়াও নিয়ন্ত্রিত শ্বাস কার্যের যেসব উপকারীতা আছে সেগুলিও এই প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে পেতে পারেন ।
কিছু সীমিত পরিস্থিতি বাদে প্রানায়ম অভ্যাস একটি সহজ এবং সুরক্ষিত পদ্ধতি নিজেদের আগামী দিনগুলি তুলনামূলক সুস্থ ভাবে কাটানোর জন্য । কিছু কিছু ক্ষেত্রে যেমন যাদের উচ্চ-রক্তচাপ আছে বা হৃদযন্ত্রে সমস্যা আছে তাদের জন্য এই প্রানায়ম একেবারেই অভ্যাস করা উচিৎ নয় । এছাড়া যাদের সবেমাত্র কোনো ধরনের সার্জারী হয়েছে, তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ ।
সুর্য্য-ভেদী প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ে, তাই অতিরিক্ত গরমে বা জ্বর হয়েছে এরকম পরিস্থিতিতে এই প্রানায়ম অভ্যাস করা একেবারেই উচিৎ না ।
অভ্যাসের সময় কোনোরকম অস্বস্থি লাগলে বা শরীর খারাপ মনে হলে তৎক্ষণাৎ অভ্যাস বন্ধ করে দিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে ।
সুর্য্য-ভেদী প্রানায়ম (Surya bhedi pranayama) একটি প্রাথমিক স্তরের অভ্যাস যা করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো বিধি-নিষেধ নেই । প্রাথমিকভাবে শ্বাস টানা এবং ছাড়ার দিকে লক্ষ্য রাখলেই চলবে তবে অভ্যস্ত হয়ে গেলে অবশ্যই সময় বাড়াতে হবে । এক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে শ্বাস ছাড়ার সময়, টানার থেকে দ্বিগুণ হয় অর্থাৎ ১ সেকেন্ড সময় শ্বাস টানতে লাগলে ছাড়তে ২ সেকেন্ড সময় লাগা উচিৎ ।
এই নিবন্ধে সুর্য্য-ভেদী প্রানায়মের একটি সহজ পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে , এই প্রানায়ম অগ্রিম স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য জলন্ধর বন্ধন করেও করা যেতে পারে । তবে সেটা নিতান্তই অগ্রিম স্তরের অভ্যাস, তাই এখানে সেটা নিয়ে বিষদে আলোচনা করা হয়নি ।
প্রানায়মের এই প্রকরণ খুবই সহজ এবং আকর্ষনীয় । এর অভ্যাসের ফলে বেশ কিছু উপকার আমরা পেতে পারি । তাই আর দেরী না করে শুরু করে দিন প্রতিদিন সুর্য্য-ভেদী প্রানায়ম অভ্যাস ।
প্রানায়ম সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন । ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।
আমরা সাধারনত একটা কথা বলে থাকি যে কোনোকিছুই অতিরিক্ত ভালো না । এই একই কথা…
শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই একটি বহুল প্রচলিত অভ্যাসের নাম হল “যোগ”…
‘স্বাস্থ্য’ কথাটা শুনলে আমরা সাধারনভাবে শুধু শরীরের কথাই ভেবেথাকি, ঠিক পদ্ধতিতে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের…
প্রাচীনকাল থেকে যেসকল কৃষিজ শষ্য মানবজাতির কাছে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তার মধ্যে ডাল (Lens…
সূচনা (Introduction) প্রোটিন (Protein) একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রোনিইট্রিয়েন্ট (Macronutrient) যার উৎস (protein sources) আমাদের প্রতিদিনের গ্রহন…
যোগাভ্যাসের বিভিন্ন ধরনের আসন, যা আমাদের দেহের নীচের অংশ যেমন পা, কোমর পেট এবং পিঠ…