মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন (Mindfulness Meditation) একটা মানসিক অনুশীলন যা অভ্যাসের ফলে আমাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব হ্রাস পায়, শরীর ও মন শান্ত হয় এবং প্রতিটা মূহুর্তে নানা ধরনের চিন্তা ভাবনা মাথায় এসে বিব্রত করে তোলার প্রবনতা কমে ।
এই মেডিটেশন অনুশীলনের ফলে অনুশীলনকারীর মধ্যে বেশ কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়, যেমন মনোসংযোগ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি, ফোকাস বজায় রাখা, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি ইত্যাদি । মেডিটেশন অনুশীলনের অভ্যাসের জন্য চাই ধৈর্য এবং প্রতিদিন কিছুটা করে সময় ।
মাইন্ডফুলনেস একধরনের স্বাভাবিক মানসিক অবস্থান
এই মানসিক অবস্থান আমাদেরকে বর্তমান এবং বর্তমান পরিস্থিতির ঘটে যাওয়া প্রতিটা মূহুর্তের সঙ্গে জুড়ে রাখে । আমাদের অবস্থান, আমাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন থাকা বা আমাদের চারপাশে যা ঘটছে তার উপর নির্ভর করে মাত্রাতিরিক্ত রাগ, বিরক্তি বা খুশি প্রকাশ করা থেকে বিরত করাই হল মাইন্ডফুলনেস পরিস্থিতি ।
Table of Contents
- 1 মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাস কি করে করব (How to practice Mindfulness Meditation)
- 2 মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাসের পদ্ধতি (Basic process of Mindfulness Meditation)
- 3 মেডিটেশন অভ্যাসের সবথেকে ভালো সময়
- 4 মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাসের উপকারীতা (Benefits of Mindfulness Meditation)
- 5 সতর্কতা
- 6 একই রকম কিছু বিষয়
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাস কি করে করব (How to practice Mindfulness Meditation)
মেডিটেশন অভ্যাসের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করার আগে একটা কথা বলা দরকার । মেডিটেশন সাধারনত দুই ধরনের হয় ।
১) গাইডেড মেডিটেশন – এক্ষেত্রে কোনো অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক বা নির্দেশকের পরামর্শ বা পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজন, যা সঠিক পদ্ধতিতে মেডিটেশন অভ্যাস করতে সাহায্য করে ।
২) আন-গাইডেড মেডিটেশন – এই ধরনের মেডিটেশন অভ্যাস নিজের মত করে করা যেতে পারে এবং এর জন্য কোনো প্রশিক্ষকের পরামর্শ বাধ্যতামূলক নয় ।
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন একটি আন-গাইডেড মেডিটেশন অভ্যাস তাই এর অভ্যাসের জন্য কোনো নির্দিস্ট পদ্ধতি বা প্রণালী অনুসরণ করার প্রয়োজন পড়ে না । যদিও প্রাথমিকভাবে সবধরনের মেডিটেশন অভ্যাসের ক্ষেত্রেই কিছু নির্দিস্ট ধাপ অনুসরণ করার পরামর্শ আমরা দিয়ে থাকি, যার ফলে অভ্যাসকারীর মধ্যে একটা শৃঙ্খলা তৈরী হয় ।
প্রাথমিক অর্থাৎ যারা মেডিটেশন জগৎ সম্পর্কে পূর্ব পরিচিত নয়, তাদের কোন ধরনের পদ্ধতি অনুশীলন করা উচিৎ, এখানে আমরা সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব, তবে তার আগে সহজ ভাবে মাইন্ডফুল মেডিটেশন সম্পর্কে একটু জেনে নিই ।
মাইন্ডফুল মেডিটেশন অভ্যাসের মূল উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে বর্তমানের সঙ্গে জুড়ে থাকা
অনেকসময় রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেও আমরা লক্ষ্য করি না বা কোনো একটা দোকান লক্ষ্য করে আসলেও বাড়িতে ফিরে মনে করতে পারি না, যে সেই দোকানটা খোলা ছিল না বন্ধ ছিল । এরকম ঘটনা খুব সাধারন এবং আমরা এইধরনের অন্যমনস্কতা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত হই না কখনই ।
আসলে রাস্তা দিয়ে হাটার সময় বা যেকোনো সময়েই হোক আমরা ঐ মূহুর্তে দাঁড়িয়ে বা বসে আগের বা পরের কোনো ঘটনা নিয়ে মাথার মধ্যে নাড়া-চাড়া করতে থাকি এবং তার ফলে এই মূহুর্তে কি ঘটছে তার সম্পর্কে অনেকসময় বেখেয়াল হয়ে পড়ি ।
এরকম প্রচুর ঘটনা আমাদের সঙ্গে প্রতিদিন ঘটে এবং আমরা এগুলোকে সাধারন ব্যাপার বলে এড়িয়ে যাই । অথচ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে দিয়েই আমরা মাইন্ডফুলনেস অভ্যাস করতে পারি এবং এর জন্য আলাদা করে কোনোরকম সরঞ্জাম বা ব্যাবস্থাপনার প্রয়োজন পড়ে না । যেমন রাস্তা দিয়ে হাটার সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ রাস্তার দিকেই রাখুন । প্রয়োজনে আশে পাশে কি চলছে সেদিকেও খেয়াল রাখতে পারেন । রাস্তার পাশে কোনো দোকান থাকলে সেইসব দোকানে কোনধরনের জিনিস পাওয়া যায় সেগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন ।
ব্যস্ত সময় যেমন কর্মক্ষেত্রে বা কোনো বিশেষ কাজে যাওয়ার সময় আমাদের সময় বা মানসিকতা কোনোটাই থাকে না এতকিছু লক্ষ্য করার । সেক্ষেত্রে একটা দিকে লক্ষ্য রাখতে পারেন সেটা হল সময় । অর্থাৎ গন্থব্যস্তলে পৌছতে কত সময় লাগছে সেদিকে লক্ষ্য রাখাও একধরনের মাইন্ডফুলনেস –এর উদাহরন ।
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাসের পদ্ধতি (Basic process of Mindfulness Meditation)
মেডিটেশন বিভিন্ন পদ্ধতিতে অভ্যাস করা যায়, এবং প্রকারভেদ অনুসারে পদ্ধতির পরিবর্তন হয় । মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাসের ক্ষেত্রে সবথেকে সাধারন যে পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে তা হল নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস এর প্রতি মনোযোগ দেওয়া । সহজভাবে বলতে গেলে শুধুমাত্র নিজের প্রতিটা নিশ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করাই হল মূল পদ্ধতি ।
একস্থানে চোখ বন্ধ করে মেরুদন্ড সোজা করে সুখাসন, পদ্মাসনে বা সিদ্ধাসনে বসে নিজের শ্বাস কার্য পর্যবেক্ষন করতে হবে । এই অভ্যাসের সময় খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিভিন্ন কারন যেমন কোনো গুরুত্ব পূর্ণ কাজ, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা, কারোর সঙ্গে মনোমালিন্য এগুলো মনে পরে যাবে এবং যার ফলে মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটবে । এরকম ক্ষেত্রে আপনার করনীয় একটাই কাজ এবং তা হল এইসমস্ত ব্যাপার থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে নিজের শ্বাস প্রশ্বাস এর প্রতি নিবদ্ধ করা ।
প্রাথমিকভাবে যারা মেডিটেশন অভ্যাস শুরু করবেন তাদের জন্য এটা এত সহজ ব্যাপার বলে মনে হবে না, কিন্তু এতে বিরক্ত হয়ে লাভ নেই । তার থেকে ঐভাবে পরপর কয়েকদিন বসার অভ্যাস করুন । আস্তে আস্তে মনোসংযোগের ব্যাঘাত ঘটার প্রবনতা কমে যাবে । এক্ষেত্রে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে, যে ভাবনা চিন্তা উদয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার তাই এটা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করার দরকার নেই । কিন্তু মেডিটেশন অভ্যাসের সময় কোনো ভাবনা চিন্তার প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে নিজের শ্বাস প্রশ্বাস এর প্রতি মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে পারলেই হবে ।
এইভাবে অন্তত ১০-১৫ মিনিট অভ্যাস করতে পারলেই আপনি সফলভাবে মেডিটেশন করতে পেরেছেন ।
এখানে পড়ুন : মেডিটেশন অভ্যাসের পদ্ধতি
মেডিটেশন অভ্যাসের সবথেকে ভালো সময়
বৈদিক শাস্ত্রমতে সূর্যোদয়ের সময় অর্থাৎ ভোরবেলা হল ধ্যান বা মেডিটেশনের সবথেকে উৎকৃষ্ট সময় । এর ব্যাখ্যা হিসেবে গবেষণায় দেখা গেছে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে আমাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ থাকে এইধরনের কার্যকলাপ করার জন্য । দিনের অন্যান্য সময় আমরা নানারকম কাজে কমবেশী জড়িয়ে পড়ি, যার ফলে মস্তিষ্কেও এই সমস্ত কাজের প্রতিফলন ঘটে । তাই সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে অন্তত ১০-১৫ মিনিট মেডিটেশন অভ্যাসের পরামর্শ আমরা দিয়ে থাকি ।
সকালে মেডিটেশন অভ্যাসের ফলে সারাদিনের কাজকর্মে আলাদা একটা উদ্যম পাওয়া যায়
যদিও ভোরবেলা মেডিটেশন অভ্যাসের জন্য আদর্শ সময়, তার মানে এই নয় যে দিনে অন্য কোনো সময় মেডিটেশন অভ্যাস করা যায় না । তাই আপনি নিজের সুবিধামত দিনের কিছুটা সময় বেছে নিয়ে মেডিটেশন অভ্যাস করতে পারেন ।
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাসের উপকারীতা (Benefits of Mindfulness Meditation)
বর্তমানে আমাদের কাছে সময়ের মূল্য অনেক । সকালে ঘুম থেকে ওঠার থেকে রাতে ঘুমানোর আগের মূহুর্ত অবধি আমরা সারাদিন সময়ের মূল্যায়নে ব্যাস্ত থাকি । তার মধ্যে থেকেই দিনের ১৫-২০ মিনিট সময় যদি কোনো একটা নির্দিস্ট কাজের জন্য বরাদ্দ করি, তাহলে অবশ্যই সেই কাজের থেকে আমরা কি প্রতিদান পাচ্ছি সেটা জানা একান্ত দরকার ।
যেকোনো ধরনের মেডিটেশন অভ্যাসের ফলে একইধরনের কিছু উপকারীতা পেয়ে থাকি, যেমন –
- মনোযোগ বৃদ্ধি,
- মানসিক চাপ কমা,
- মানসিকদিক থেকে শান্ত করে তোলে,
- বিষন্ন ভাব কেটে যায়,
- অহেতুক উত্তেজিত হওয়ার প্রবনতা কমে,
- আত্মনিয়ন্ত্রন বৃদ্ধি ইত্যাদি ।
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন অভ্যাসের ক্ষেত্রে উপরোক্ত উপকারীতাগুলির পাশাপাশি নিজের এবং চারপাশ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, একাগ্রতা বৃদ্ধি, সৃজনশীলতা বৃদ্ধি এইধরনের প্রভাব দেখা যায় । এইধরনের প্রভাবের ফলে পরোক্ষভাবে আমাদের কর্মজগত, শিক্ষাজগত বা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হয় । এর ফলে সার্বিকভাবে আমাদের মানসিক এবং চারীত্রিক উন্নতি হয় ।
এখানে পড়ুন : মেডিটেশনের উপকারীতা
সতর্কতা
সাধারনভাবে মেডিটেশন অভ্যাসের ফলে কোনোরকম শারীরিক সমস্যা হয় না, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে অনুশীলনকারী উপকারের থেকে বেশী সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েন । মেডিটেশন অভ্যাস করার সময় কোনো নির্দিস্ট বস্তু বা নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করার সময় তাদের মধ্যে অতিরিক্ত উত্তেজনার সৃষ্টি করে । আবার অনেকে শারীরিক অসুস্থতা যেমন মাথা ঘোরা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, বুকে ব্যাথা এই ধরনের সমস্যা অনুভব করে থাকেন ।
মেডিটেশন অভ্যাসের ফলে আপনিও যদি এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন, তাহলে অবশ্যই মেডিটেশন অভ্যাস থেকে নিজেকে বিরত করে কোনো অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের পরামর্শ নিন । আরও একটা জিনিস মনে রাখবেন, মেডিটেশন অভ্যাস করার মূল উদ্দেশ্য নিজেকে মানসিকভাবে স্বচ্ছন্দ করে তোলা । অভ্যাসের সময় নিজের সমস্যাগুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে আপনি নিজেকে অহেতুক উত্তেজিত করে নিজের জন্য সমস্যার সৃষ্টি করছেন না তো?
সারমর্ম
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন (Mindfulness Meditation) অভ্যাস করে নিজেকে আরও উন্নত করে তুলুন, কিন্তু অবশ্যই নিজের সুস্থতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে । প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে নিজেকে অনুভব করে দেখুন । যদি এই প্রতিবেদনটি আপনার কাজের বলে মনে হয় তাহলে নীচে কমেন্টের মাধ্যমে আপনার মতামত জানাতে ভুলবেন না । কোনো পরামর্শ থাকলেও সেটাও আমাদের জানাতে পারেন । মেসেজ বা ইমেলের মাধ্যমে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।