প্রাচীনকাল থেকে যেসকল কৃষিজ শষ্য মানবজাতির কাছে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তার মধ্যে ডাল (Lens culinaris) একটি অন্যতম শষ্য । আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ডাল (lentils) একটি প্রধান খাদ্যবস্তু হিসেবে নহুকাল আগে থেকেই ব্যাবহৃত হয়ে এসেছে, যার মূল কারন ডালের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফাইবার, প্রোটিন এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ ।
ডাল একটি শিমগোত্রীয় শষ্য, যা বিভিন্ন সাইজ এবং কালো, লাল, সবুজ, খয়েরী অথবা হলুদ রং এর হয় । ডাল খাদ্যবস্তু হিসেবে গ্রহনের মাধ্যমে আমরা কমবেশী প্রায় ২৫% প্রোটিন পেয়ে থাকি যা মাংসের বিকল্প হিসেবে ব্যাবহার হয়ে থাকে । বিশেষত যারা নিরামিষাশী, তাদের ক্ষেত্রে প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ করতে ডাল সাহায্য করে ।
Table of Contents
ডালের পুষ্টিগত উপাদান (Nutrional Facts of Lentils)
বছরের পর বছর ধরে ডাল আমাদের কাছে জনপ্রিয় খাদ্য এই কারনেই নয় যে এতে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন পাওয়া যায় । সবথেকে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হল প্রাকৃতিক উপায়ে প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর খাদ্যতালিকার মধ্যে ডাল একটি সহজলভ্য । এছাড়া বিভিন্ন রকম সুস্বাদু পদ হিসেবে পরিবেশন করা যায়, যাতে একঘেয়েমি না লাগে । শুধুমাত্র স্বাদ নয়, ডালের পুষ্টিগত উপাদান একে প্রধান খাদ্য হিসেবে সাধারনত গ্রহন করা হয় ।
বিভিন্ন ধরনের ডাল থেকে প্রাপ্ত পুষ্টিগত উপাদানের প্রকার এবং পরিমান ভিন্ন, কিন্তু সাধারনভাবে এক কাপ রান্না করা ডালে যেসকল পুষ্টিগত উপাদান পাওয়া যায় সেগুলি হল –
- প্রোটিন
- ফাইবার
- পটাসিয়াম
- ফোলেট
- আয়রন
- ম্যাঙ্গানিজ
প্রোটিন (Protein)
আমরা সবাই জানি মাংসে প্রচুর পরিমানে প্রোটিন (প্রতি ১০০ গ্রামে ২৬-২৭ গ্রাম) থাকে, কিন্ত এর পাশাপাশি মাংসে ফ্যাট থাকে যা আমাদের হৃদযন্ত্রের (heart) এর জন্য ক্ষতিকারক । অন্যদিকে একবাটি সেদ্ধ ডাল থেকে প্রায় ১৩-২৫ গ্রাম (বিভিন্ন ডাল থেকে প্রাপ্ত প্রোটিনের পরিমান ভিন্ন) প্রোটিন পাওয়া যায়, কিন্তু ফ্যাটের পরিমান কম থাকায় হার্টের স্বাস্থ্যে কোনো প্রভাব ফেলে না ।
ফাইবার (Fibre)
ফাইবার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষত পাচনতন্ত্রের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যোপাদান । এক বাটি ডাল থেকে আমাদের দৈনিক প্রয়োজনের প্রায় ৩০% ফাইবার আমরা পেয়ে থাকি, যা আমাদের কোলেস্টেরল স্তর ঠিক রাখতে এবং রক্তের শর্করার পরিমান নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে ।
পটাসিয়াম (Pottasium)
এটি এক ধরণের প্রয়োজনীয় খনিজ (minerals), যা আমাদের আমাদের কোষের তরলের পরিমান সঠিক রাখতে সাহায্য করে । এছাড়াও শরীরে অতিরিক্ত পরিমান সোডিয়ামের প্রভাব প্রশমিত করতে পটাসিয়াম সাহায্য করে । এক বাটি ডাল থেকে সাধারনত 273mg পটাসিয়াম পাওয়া যায় ।
ফোলেট (Folate)
ফোলেট হল B টাইপ ভিটামিন (Vitamin B9) যা লোহিত রক্ত কণিকা (red blood cell) গঠন করতে এবং স্নায়ুর সঠিক কার্যকলাপের জন্য ফোলেট একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান । এছাড়াও গর্ভাবস্থায় মহিলাদের স্বাস্থ্যের জন্য ফোলেট খুবই প্রয়োজনীয় ।
আয়রন (Iron)
আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের প্রায় ১৩-১৫% আয়রন আমরা এক বাটি ডাল থেকে পেতে পারি । আমরা জানি শরীরে আয়রনের অভাবে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া (Anemia) রোগ হয়, যা উন্নয়নশীল যেকোনো দেশের জন্য একটি খুবই সাধারন ব্যাপার ।
ম্যাঙ্গানিজ (Manganese)
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যোগান, হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে, ক্ষত নিরাময় করার জন্য প্রয়োজন হয় । এছাড়া বেশ কিছু উৎসেচকের অংশ হিসেবে কাজ করে । ম্যাঙ্গানিজ সাধারনত হাড়ে সঞ্চিত থাকে । এছাড়াও যকৃৎ, কিডনি এবং অগ্ন্যাশয়ে ম্যাঙ্গানিজ সঞ্চিত থাকে ।
ডাল এবং স্বাস্থ্য (Lentils and Health)
বিশ্বের যেসব অঞ্চলে এখনও প্রচুর মানুষ দরিদ্রসীমার নীচে বাস করে, তারা ডাল প্রধান খাওয়ার হিসেবে ব্যাবহার করে । কারন ডাল খাওয়ার ফলে স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় মাইক্রো এবং ম্যাক্রো – নিউট্রিয়েন্ট যেমন জিঙ্ক, আয়রন, ভিটামিন পাওয়া যায় । এছাড়া ডালে প্রাপ্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণও খুব কম, ফলে ফ্যাটজনিত সমস্যা ডাল খাওয়ার ফলে হয় না ।
- ডালে পলিফেনল পাওয়া যায়, যা একধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং সম্প্রতি গবেষনায় দেখা গেছে ডালে প্রাপ্ত পলিফেনল ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধির কোষের বৃদ্ধি কমাতে পারে ।
- ডালে প্রাপ্ত মাইক্রো এবং ম্যাক্রো – নিউট্রিয়েন্টস যেমন ফাইবার, পটাসিয়াম, ফোলেট আমাদের হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।
- আমাদের পাচনতন্ত্রের কার্যকলাপ সঠিক থাকে, ফলে রক্তে শর্করার পরিমান নিয়ন্ত্রনে থাকে । এছাড়া ডালের গ্লাইকেমিক ইনডেক্স (GI) কম, ফলে ডাল খাওয়ার ফলে রক্তে শর্করার হঠাত বৃদ্ধির রিস্ক কম থাকে ।
ডালের প্রকারভেদ (Types of Lentils)
আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যেসকল ডাল নানারকম ভাবে তৈরী করে থাকি, সেগুলি হল –
মুগ ডাল (Moong Dal) | ২৪ গ্রাম প্রোটিন প্রতি ১০০ গ্রামে |
মসুর ডাল (Masoor Dal) | ২১ গ্রাম প্রোটিন প্রতি ১০০ গ্রামে |
ছোলার ডাল (Bengal Gram) | ১৪ গ্রাম প্রোটিন প্রতি ১০০ গ্রামে |
তুরের ডাল (Pigeon Pea) | ১৩ গ্রাম প্রোটিন প্রতি ১০০ গ্রামে |
অডহর ডাল (Udar Dal) | ২৬ গ্রাম প্রোটিন প্রতি ১০০ গ্রামে |
সতর্কতা (Check Point)
অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে ডাল পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবেই গ্রহনযোগ্য, কারন ডালে যেধরনের পুষ্টিগুন পাওয়া যায় সেগুলি আমাদের শরীরের জন্য খুবই গুরুত্ব পূর্ণ । তাসত্ত্বেও লক্ষণীয় বিষয় হল ডালে অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায়, যা অন্যান্য নিউট্রিশনাল উপাদানগুলি আমাদের শরীরে মিশে যেতে বাধা দেয় । ফলে প্রচুর পরিমানে ডাল খেলে অনেক সময় পেট ভারি, ঢেঁকুর ওঠা বা বদহজমের মত সমস্যা দেখা যায় ।
যদিও ডাল ভিজিয়ে রেখে বা সেদ্ধ করে নিলে অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্টের প্রভাব অনেকাংশেই কমে যায় ।
সারমর্ম (Conclusion)
বর্তমান সময়ে নিরামিষাশী মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে, এবং এক্ষেত্রে বিভিন্ন বয়সের মানুষকে নিরামিষ খাদ্যাভ্যাস করতে দেখা যায় । নিরামিষ খাওয়ার ফলে সবথেকে বড় সমস্যা দেখা যায় – প্রোটিনের অভাব । নিরামিষ খাদ্যবস্তুর মুধ্যে সয়াবিণের পরে ডাল অন্যতম প্রোটিনের উৎস । ডাল (lentils) এমন একটি খাদ্যবস্তু যা সুস্বাদু পদ হওয়ার পাশাপাশি আমাদের খাওয়ারে প্রচুর পুষ্টিকর মান যোগ করে । এরফলে যেকোনো বয়সের মানুষ ডাল স্বচ্ছন্দে খেতে পারেন ।
তবে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে কোনোকিছুই অতিরিক্ত পরিমানে ভালো নয়, সুতরাং পরিমিত মানে খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।