মেডিটেশন বা ধ্যান

ওম – রহস্য এবং উৎস (AUM – Mystery and Origin)

ওম বা অউম (AUM) একটি পবিত্র শব্দ, যা অন্যান্য শব্দের উৎস । কথায় আছে একহাতে তালি বাজে না । কিন্তু প্রকৃতঅর্থে এককভাবে প্রায় কোনো শব্দই (sound) তৈরী হয় না । আমরা যে সকল শব্দ শুনতে পাই সেগুলো অন্তত দুটো তল বা বস্তুর সংস্পর্শে তৈরী হয় । যেমন আমরা কথা বলি, যাতে আমাদের জিভ, তালু, দাঁত এবং ঠোট জড়িত থাকে । সমুদ্রের ঢেউ এর গর্জন দুটো ঢেউ এর ধাক্কায় সৃষ্টি হয় ।

মানব দেহে শব্দের উৎস

কখনো ভেবে দেখেছেন আমরা কথা বলি কিভাবে? হাসি, কান্না, কথা বলা সবেতেই আমরা যে শব্দ করি, সেটা উৎপন্ন হয় কিভাবে? কোনো তারের বাদ্যযন্ত্রে যেমন   বাতাসে তারের কম্পনের মাধ্যমে সুর তৈরী হয়, ঠিক তেমনভাবে ফুসফুস থেকে নির্গত বাতাস যা আমাদের মুখ ও নাক থেকে বাইরে বেরোয়, স্বরতন্ত্রী (vocal cord) র কম্পন এবং জিভ, ঠোট, তালু বা দাঁতের  একে অপরের স্পর্শের দ্বারা আমরা শব্দ তৈরী করে থাকি । যেমন ‘ট’ উচ্চারনের সময় আমাদের জিভ উপরের তালুর সামনের ভাগ স্পর্শ করে, আবার ‘দ’ উচ্চারনের সময় জিভ উপরের পাটির দাঁত স্পর্শ করে ।

Articulatory System of Human Body

‘অউম’ বা ‘ওম’ – এর সঙ্গে পরিচিতি (Knowing about AUM)

এমন কিছু শব্দ আছে যা জিভের নড়াচড়া ছাড়াই উচ্চারণ করা যায় । যেমন অ, ও, উ, এম । এক্মটু ভাবুন আমরা আমাদের চারপাশে যা দেখি প্রতিটা বস্তুর নিজস্ব বর্ণ বা রঙ (colour) আছে । তাই তো? কিন্তু জানেন কি প্রতিটা বর্ণ বা রঙের মূলে আছে তিনটি মূল বর্ণ – লাল, সবুজ এবং নীল, ইংরাজীতে যাকে বলে RGB colour । এই তিনটি রঙ বিভিন্ন অনুপাতে মিশে অন্যান্য রঙ তৈরী হয় ।  তেমনই ‘অ’, ‘উ’, ‘ম’ এগুলিকে বলা হয় অন্যান্য শব্দের আধার । সাধারণত এই কটি শব্দের মিশ্রণে তৈরী হয় অন্য শব্দগুলো । ‘অ’, ‘উ’ বা ‘ম’ দিয়ে উচ্চারিত কথা বা শব্দ (word) টি হল ‘অউম’ বা ‘ওম’ (স্ংস্কৃতে ‘অ’ এবং ‘উ’ একত্রে উচ্চারণ ‘ও’) । ‘অউম’ বা ‘ওম’ কে বলা হয় universal sound । এটি একটি পবিত্র শব্দ এবং হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক প্রতীক ।   

প্রতিটা মুখ্য ধর্মের একটি নিজস্ব universal sound আছে । যেমন হিন্দুধর্মে ‘ওম (om)’, ইসলামধর্মে ‘আমিন (amin)’ আবার খ্রীস্টান ধর্মে ‘আমেন (amen)’ । তেমনই তিব্বতি মতে ‘হুম (hum)’ ।

‘অউম’ বা ‘ওম’ – এর প্রতীকীকরন (Symbolisation of AUM)

অউম – এর চিহ্নটি হল। এটি গঠিত হয়েছে ৩টি বক্ররেখা (১,২,৩), ১টি বিন্দু (৪) এবং ১টি অর্ধবৃত্ত (৫) এর দ্বারা ।

AUM Symbolisation

উর্দ্ধমুখী বক্ররেখাটি (১) আমাদের গভীর নিদ্রিত অবস্থা (সুশুপ্তি) কে বোঝায় যা আমাদের অচেতন পরিস্থিতি । এই অবস্থায় আমরা এতোটাই গভীর ঘুমে থাকি যে স্বপ্নও দেখি না ।

সবথেকে বড় নিম্নমুখী বক্ররেখাটি (২) আমাদের জেগে থাকার (জাগ্রত) অবস্থার প্রতীক যখন আমাদের সমস্ত সচেতনতা আমরা পঞ্চইন্দ্রিয়র মাধ্যমে অনুভব করতে পারি । এঈ বক্ররেখাটির বৃহৎ আকার দিনের অধিকাংশ সময় আমাদের জাগ্রত অবস্থাকেই বোঝায় ।

মাঝখানের (যেটি আমাদের জাগ্রত এবং সুশুপ্ত অবস্থার মাঝখানের অবস্থা) বক্ররেখাটি (৩) আমাদের অবচেতন পর্যায়কে বোঝায় যখন আমরা স্বপ্ন (স্বপ্ন) দেখি । 

চিহ্নের উপরিভাগে একটি বিন্দু (৪) অবস্থিত যা চেতনার চতুর্থ পর্যায়কে বোঝায় যাকে সংস্কৃতে বলা হয় ‘তূরীয়’ । এটি হল পরম পর্যায় যা আমাদের অন্য তিনটি পর্যায় যথা সুশুপ্তি, জাগ্রত এবং স্বপ্ন অবস্থাকে আলোকিত করে এবং প্রকৃত সুখের সন্ধান পাওয়া যায় ।

চিহ্নের শেষ অংশটি হল একটি অর্ধবৃত্ত (৫) যা বিন্দুর থেকে অন্য তিনটি বক্ররেখাকে আলাদা করে রাখে । এটি মায়া বা illusion যা পরম সুখ অনুভব করার থেকে প্রতিরোধ করে । চিহ্নটি ভালো করে দেখলে দেখা যাবে অর্ধবৃত্তটির (৫) সঙ্গে বিন্দুটির (৪) কোনভাবে সংযুক্ত ন্য় । যার অর্থ চরম পর্যায় কোনভাবে মায়ার দ্বারা প্রভাবিত হয় না । ‘মায়া’ অন্য তিনটি পর্যায় যথা সুশুপ্তি, জাগ্রত এবং স্বপ্ন পর্যায় অতিক্রম করে এই চতুর্থ বা চরম পর্যায়ে পৌছানো প্রতিহত করে ।

‘অউম’ বা ‘ওম’ – এর উচ্চারণ (Pronounciation of AUM)

যখন ‘অউম’ মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়, তিনটি  অক্ষর যথাযথ ভাবে উচ্চারণ করা উচিৎ । ‘অউম’ মন্ত্রের প্রতিটা অক্ষর তার নিজস্ব কিছু অর্থ ধারন করে ।

অ(A) হল মহাজাগতিক সৃজনশীল একটি কম্পনের প্রতীক যেটি সৃষ্টির সূচনা করে । এবং এর উচ্চারণ কাল সংক্ষিপ্ত ।

উ(U) হল মহাজাগতিক সংরক্ষন কম্পন যা সৃষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করে । Meditation বা মন্ত্রোচ্চারণের সময় ‘উ’ এর উচ্চারণকাল এবং কম্পনমান উভয়ই সংক্ষিপ্ত ।

ম(M) হল মহাজাগতিক দ্রবীকরণ বা বিলয় কম্পন যা মহাজাগতিক চক্রের শেষে সমস্ত সৃষ্টিকে পরম অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যায় ।

মহাজাগতিক প্রাকাশের জন্য নিযুক্ত এই সময় ব্রহ্মকাল হিসেবে পরিচিত, যা কোটি কোটি বছর ধরে চলতে থাকে ।

সারমর্ম

‘অউম’ একটি পবিত্র এবং শক্তিশালী শব্দ বা মন্ত্র, যা meditation করার সময়েও আমরা উচ্চারণ করে থাকি । ‘অউম’ মন্ত্রোচ্চারনের ফলে আমাদের মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকে । আমরা অনেক বেশী নিজেকে কেন্দ্রীভুত করতে পারি কোন একটি নির্দিস্ট বিষয়ে । শিশুদের ক্ষেত্রে মনোযোগ একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ‘অউম’ উচ্চারণ অভ্যাসের ফলে বৃদ্ধি পায় । এছাড়াও আরো অনেক উপকারীতা আছে ‘অউম’ মন্ত্রোচ্চারনের । তাহলে আগামী ১৫ দিন অন্তত ১০ মিনিট সময় ‘অউম’ মন্ত্রোচ্চারণের অভ্যাস করে দেখা যাক, আমরা কি উপকার পাই । কি বলেন? ১৫দিন অভ্যাসের পরে আপনাদের অভিজ্ঞতা আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানান । এবং অবশ্যই লেখাটি পড়ে কেমন লাগল, আপনাদের কোন মতামত, কোন প্রশ্ন থাকলে আমাদের জানান । ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন । অন্যকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করুন ।   

How useful was this post?

1
San

Recent Posts

মে দিবস (May Dibas)

“মে দিবস” মানে  - ছুটি, আনন্দেতে ভাসি, শ্রমিক-শহীদ – তাদের গল্প আজ হয়েছে বাসি ।।…

1 month ago

শুভ নববর্ষ ১৪৩২

নতুন বছর, নতুন কাপড়, নতুন কিছু পাওয়া, সবকিছুরই মাঝে কেমন বিষাদময় হাওয়া।। ভাঙছি মোরা, খুঁড়ছি…

2 months ago

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ইতিহাস (History of International Women’s Day)

আজ ৮ই মার্চ । বিশ্ব নারী দিবস (International Women's Day) ।প্রতিবছর এই দিনটি উদযাপিত হয়…

3 months ago

প্রতিদিন হাঁটার উপকার (Benefits of Daily Walk)

প্রতিদিন নিয়ম করে হাঁটা সকলের জন্য উপকারী (benefits of walk) এটা আমরা সবাই জানি। নিয়মিত…

5 months ago

মেডিটেশনের খারাপ প্রভাব (Adverse Effect of Meditation)

আমরা সাধারনত একটা কথা বলে থাকি যে কোনোকিছুই অতিরিক্ত ভালো না । এই একই কথা…

8 months ago

প্রতিদিন যোগাভ্যাসের উপকারীতা (Benefits of Practicing Yoga for Everyday)

শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই একটি বহুল প্রচলিত অভ্যাসের নাম হল “যোগ”…

9 months ago