চিকিৎসাশাস্ত্র এবং বিশেষজ্ঞদের মতানুসারে ভিটামিন C (Vitamin C) এমন একটি খাদ্যোপাদান, যার প্রভাব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানবদেহের বিভিন্ন কার্যকলাপ যেমন ত্বকের গঠনগত মান উন্নয়ন, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, দ্রুত ক্ষত নিরাময় করে ।
ভিটামিন C (Vitamin C) বা অ্যাসকরবিক অ্যাসিড (Ascorbic Acid) একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন, যা বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের মাধ্যমে আমরা পেয়ে থাকি । এই ভিটামিনের অভাবের কারনে নানারকম শারীরিক সমস্যা দেখা যেতে পারে, সেইকারনে এর অভাব পূরনের জন্য পরিপূরক হিসেবে ভিটামিন C ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট নেওয়া যেতে পারে ।
Table of Contents
ভিটামিন C (Vitamin C) এর প্রয়োজনীয়তা
যেকোনো ধরনের খাদ্যোপাদানের নিজস্ব কিছু গুনাগুন থাকে, এবং প্রতিদিন যথাযথ পরিমানে সেইসব খাদ্যোপাদান খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহনের ফলে আমরা সুস্থ জীবনযাপন করি । ভিটামিন C একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অপরিহার্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট, যা সঠিক পরিমানে প্রতিদিন খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহনের ফলে আমরা কি কি ধরনের উপকার পেতে পারি সেগুলি জেনে নিই ।
হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে
গবেষনায় দেখা গেছে, ভিটামিন C এর যথাযথ পরিমান গ্রহনের ফলে বেশকিছু কার্যকলাপের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নতি ঘটতে পারে ।
রক্তনালীর পরিসর বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে
নাইট্রিক অক্সাইডের (eNOS) উৎপাদন বৃদ্ধি করে
উপযুক্ত পরিমানে ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাওয়ার (বাজারজাত পরিপূরক না) হৃদযন্ত্রের রোগের ঝুকি কমাতে সাহায্য করে ।
ত্বকের গঠনগত মান ভালো করে
সুস্থ এবং ভালো ত্বকের জন্য বেশী পরিমানে ভিটামিন C যুক্ত খাওয়ার প্রতিদিন খাওয়া প্রয়োজন, কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন? আসলে ভিটামিন C এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য এবং কোলাজেন সংশ্লেষ, ভিটামিন C কে ত্বকের জন্য অন্যতম গুরুত্ব প্রদান করে । এছাড়াও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ভিটামিন C সানবার্ন এবং ট্যান রোধ ও নিরাময় করতে সাহায্য করে ।
ক্ষত নিরাময় করে
বেশ কিছু গবেষণায় পাওয়া গেছে, ভিটামিন C ক্ষত নিরাময়ের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । বিশেষত শরীরের কোনো অংশ পুড়ে গেলে, পোড়া স্থানের ক্ষত সারিয়ে তোলা এবং দাগ মেটানোর ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করে । এছাড়া রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এবং সংক্রমণ রোধ করতেও ভিটামিন C গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় ।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় প্রচুর মানুষের ঠান্ডা লাগার প্রবনতা দেখা যায়, তার কারন আর কিছুই না । রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তাদের মধ্যে কম । ভিটামিন C, শ্বেত রক্তকণিকার(WBC) মূলত লিম্ফোসাইট (Lymphocytes) এবং ফ্যাগোসাইট (Phagocytes) এর উৎপাদন বৃদ্ধি করে, যা আমাদের কোনো সংক্রমন থেকে রক্ষা করে ।
এছাড়াও ভিটামিন C, শ্বেত রক্তকণিকাগুলিকে ফ্রি র্যাডিক্যালস থেকে রক্ষা করে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে,
সাধারন সর্দি-কাশির ক্ষেত্রে ভিটামিন C এর উপযোগীতা এখনও প্রমানিত নয়
রক্ত চাপ কমাতে এবং নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে
২০১৭ সালের একটা সার্ভে অনুযায়ী ভারতবর্ষের প্রতি ৮ জন পিছু একজন উচ্চ রক্তচাপ বা Hypertension এর শিকার । এবং এই পরিসংখ্যান বিশ্বের সর্বত্র প্রায় একই, অর্থাৎ বর্তমান সময়ে প্রচুর মানুষ এই সমস্যায় ভুগছেন ।
বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে, ভিটামিন C উপযুক্ত পরিমানে গ্রহন করলে রক্তচাপ কিছুটা হলেও কমে এবং যাদের রক্তচাপ স্বাভাবিক, তাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে ।
গাউট কমাতে সাহায্য করে
গাউট একধরনের বাত যা প্রচন্ড বেদনাদায়ক এবং কালক্রমে হাড়ের জয়েন্টে জ্বলাভাব এবং ফোলাভাব বৃদ্ধি করে । ইউরিক অ্যাCড আমাদের শরীরে তৈরী একধরনের বর্জ্যপদার্থ, যা বেড়ে গিয়ে স্ফটিকের আকারে হাড়ের সংযোগস্থলে জমা হয় । যার ফলে গাউট হয় ।
বিভিন্ন গবেষনায় দেখা গেছে ভিটামিন C রক্তে ইউরিক অ্যাসিড কমাতে সাহায্য করে, যার ফলে গাউট হওয়া প্রতিরোধ করে ।
আয়রনের অভাব প্রতিহত করে
রক্তে লোহিত রক্তকনিকা গঠন, সমগ্র শরীরে অক্সিজেনের পরিবহনের মত বেশকিছু গুরুত্বপূর্ন কাজের জন্য আয়রন অপরিহার্য । ভিটামিন C খাদ্যের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয়রন শোষনে সাহায্য করে । বিশেষত নিরামিষাশী দের ক্ষেত্রে উদ্ভিজ্জ খাদ্যবস্তু থেকে আয়রন শোষনের মান উন্নত করে ।
এছাড়াও যেসকল বিষয়ে ভিটামিন C এর উপযোগীতা পাওয়া গেছে সেগুলি হল –
- ভিটামিন C ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে (প্রমানসাপেক্ষ)
- মাড়ির রক্তক্ষরণ রোধ করে
- ওজন কমানোর জন্য উপযোগী
- এনার্জী বাড়াতে সাহায্য করে
- চোখের সমস্যা প্রতিহত করে (যদিও স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে উভয় ধরনের প্রমান পাওয়া গেছে)
ঘাটতির ফল
সাধারনভাবে খুব সহজলভ্য খাওয়ারে যথেষ্ট পরিমানে ভিটামিন C পাওয়া যায়, কিন্তু তারপরে খারাপ খাদ্যাভ্যাসের ফলে বা অপরিমিত জীবনযাপনের ফলে আমাদের শরীরে ভিটামিন C এর ঘাটতি দেখা যায় এবং তার ফলে যেধরনের সমস্যাগুলি দেখা যেতে পারে তা হল –
- শুষ্ক এবং রুক্ষ ত্বক
- চুল শুষ্ক এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া
- নখের স্বাভাবিক আকারের পরিবর্তন
- বিলম্বিত ক্ষত নিরাময়
- সহজেই আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া
- গাঁটে গাঁটে ব্যাথা এবং ফোলা
- শিশুদের ক্ষেত্রে হাড়ের দুর্বলতা
- মাড়ির রক্তক্ষরন
- রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া
- অ্যানিমিয়া
- ক্লান্তি
- ওজন বৃদ্ধি
এখানে পড়ুন : ভিটামিন D (Vitamin D) – প্রয়োজনীয়তা, অভাব এবং উৎস
কাদের মধ্যে ভিটামিন C এর ঘাটতির প্রবনতা বেশী
ভিটামিন C সহজলভ্য হওয়া সত্ত্বেও, অনেকের মধ্যেই ভিটামিন C এর ঘাটতি দেখা যায় । সেটা অনিয়মিত এবং অপৌষ্টিক খাদ্যাভ্যাসের জন্য হতে পারে, কিডনিজনিত চিকিৎসার কারনে হতে পারে আবার অনিয়মিত জীবনযাপনের জন্য হতে পারে । যারা নিয়মিত ধূমপান করে, তাদের মধ্যে সর্বদাই এর ঘাটতি দেখা যায় এবং সেই ঘাটতি পূরনের জন্য দৈনিক মাপের তুলনায় বেশী পরিমানে ভিটামিন C গ্রহন বাধ্যতামূলক ।
কোন কোন খাওয়ারে ভিটামিন C পাওয়া যায়
যেসকল ফল এবং শাক সবজিতে ভিটামিন C পাওয়া যায় সেগুলি হল –
- আমলকি (Indian Gooseberry),
- লেবু জাতীয় ফল যেমন কমলালেবু (Oranges), মৌসম্বীলেবু (Grapefruits), পাতিলেবু (Lemons),
- আম (Mango),
- পেয়ারা (Guava),
- পেঁপে (Papaya),
- আনারস (Pineapple),
- স্ট্রবেরী (Strawberry),
- ব্রোকলি (Broccoli),
- বেল পেপার (Red and Green Bell Pepper),
- টমেটো (Tomatoes),
- ফুলকপি (Cauliflowers),
- পালং (Spinach) ইত্যাদি ।
এছাড়াও প্রানীজ উৎস হিসেবে গরুর দুধ এবং ছাগলের দুধে খুব সামান্য পরিমানে ভিটামিন C পাওয়া যায় ।
প্রতিদিন কত পরিমানে ভিটামিন C (Vitamin C) প্রয়োজন
যেকোনো ধরনের nutrient এর ঘাটতির ফলে যেমন সমস্যা দেখা যায় ঠিক তেমনই অতিরিক্ত পরিমানে গ্রহনের ফলেও নানারকম সমস্যা দেখা দিতে পারে । যদিও প্রচুর পরিমানে পরিপূরক গ্রহনের ফলেই একমাত্র শরীরে ভিটামিন C এর বাড়তি দেখা দিতে পারে, তাই প্রাকৃতিক উৎস সবথেকে নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ ।
ICMR এবং NIN এর ২০২০ সালের প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন গ্রহনের মাত্রা –
পুরুষ | ১৮-৬০ বছর | ৮০ mg/প্রতিদিন |
মহিলা | ১৮-৬০ বছর | ৬৫ mg/প্রতিদিন |
গর্ভাবস্থায় | ৮০ mg/প্রতিদিন | |
স্তন্যদান পর্বে | ১১৫ mg/প্রতিদিন | |
শিশু | ০-১২ মাস | ৩০ mg/প্রতিদিন |
১-৩ বছর | ৩০ mg/প্রতিদিন | |
৪-৬ বছর | ৩৫ mg/প্রতিদিন | |
৭-৯ বছর | ৪৫ mg/প্রতিদিন | |
ছেলে | ১০-১২ বছর | ৫৫ mg/প্রতিদিন |
১৩-১৫ বছর | ৭০ mg/প্রতিদিন | |
১৬-১৮ বছর | ৮৫ mg/প্রতিদিন | |
মেয়ে | ১০-১২ বছর | ৫০ mg/প্রতিদিন |
১৩-১৫ বছর | ৬৫ mg/প্রতিদিন | |
১৬-১৮ বছর | ৭০ mg/প্রতিদিন |
* mg stands for miligram
এছাড়া ৬০ বছরের উর্দ্ধে প্রতিদিনের পরিমান একজন পুরুষের জন্য ৮০ mg এবং একজন মহিলার জন্য ৬৫ mg ।
সতর্কতা
ভিটামিন C একটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন, তাই প্রয়োজন অতিরিক্ত ভিটামিন মূত্রের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে যায় । কিন্তু যারা দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় ভিটামিন C এর পরিপূরক গ্রহন করে তাদের ক্ষেত্রে যেধরনের সমস্যা দেখা যেতে পারে –
বমিভাব
উদরাময় বা ডাইরিয়া
তলপেটে ব্যাথা
পেটের সমস্যা ইত্যাদি
সারমর্ম
যেকোনো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের মতই ভিটামিন C এর গুরুত্ব মানবদেহের জন্য প্রচুর কিন্তু যেহেতু এটি জলে দ্রবনীয় ভিটামিন তাই ফ্যাট দ্রবনীয় ভিটামিনের মত এটি আমাদের শরীরে সঞ্চিত হয় না । তাই সঠিক পরিমানে এই ভিটামিন আমাদের প্রতিদিন খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহন করা প্রয়োজন । ভিটামিন C সমৃদ্ধ খাদ্যদ্রব্য প্রচুর, তাই প্রাথমিকভাবে খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহন করাই বাঞ্ছনীয় । তবে কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা গেলে ডাক্তারের পরামর্শ মত পরিপূরক গ্রহন করা যেতে পারে ।
ভিটামিন C সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে নীচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন । এছাড়া ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।
একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
ভিটামিন C আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা immunity বাড়াতে সাহায্য করে, কিন্তু তা COVID 19 নিরাময় বা প্রতিহত করতে পারে এমন নয় । সুতরাং কোনো পরিপূরকের উপর ভরসা করবেন না । পুষ্টিকর খাওয়ার খান, অল্প হলেও শরীরচর্চা করুন । বাইরে বেরোতে হলে মাস্ক ব্যাবহার করুন এবং যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে চলুন ।