মেডিটেশন একধরনের অভ্যাস যা আমাদের মানসিক শান্তি পেতে সাহায্য করে । বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উপাচারে মেডিটেশন অভ্যাস করা হয়, কিন্তু যেকোনোধরনের মেডিটেশন অভ্যাসের মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য একই আর সেটা হল – মানসিক শান্তি প্রাপ্তি, একাগ্রতা বৃদ্ধি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি । সো-হাম মেডিটেশন (SO-Hum Meditation) প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত একটি মেডিটেশন পদ্ধতি যা অনুশীলনের সময়ে অনুশীলনকারীর শ্বাস প্রশ্বাস, মন্ত্রোচ্চারণ একসঙ্গে ব্যাবহৃত হয় ।
এই মেডিটেশন অভ্যাসের ক্ষেত্রে শ্বাস টানার সময় মনে মনে ‘সো’ শব্দটি উচ্চারন করতে হয়, আবার শ্বাস ছাড়ার সময় একইভাবে ‘হাম’ শব্দটি উচ্চারন করতে হয় । উপনিষদ অনুসারে ‘সো’ শব্দটির অর্থ হল ‘সে’ অথবা ‘সেই’ যার আভ্যন্তরীন অর্থ নিয়ে যদিও সংশয় আছে । কার মতে এর অর্থ ‘মহাবিশ্ব’ আবার কারও মতে ‘প্রকৃত আত্মসচেতনতা’ ।
‘হাম’ শব্দটির অর্থ ‘আমি’ অর্থাৎ নিজের উল্লেখ করা হয় । পুরো কথাটি একসঙ্গে করলে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হল – ‘আমি সেই’ বা ‘আমি এই মহাবিশ্বের অংশ’ । মহাবিশ্বের অদৃশ্য যে শক্তি অনবরত আমাদের সাহায্য করে চলেছে প্রতিটা পদক্ষেপে, প্রতিটা মূহুর্তে, মনে করা হয় ‘সো-হাম’ মন্ত্রটি এই শক্তির প্রতীকি স্বরূপ ।
Table of Contents
এই মেডিটেশন অভ্যাসের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা শুরু করার আগে একটা কথা বলা প্রয়োজন । মেডিটেশন অভ্যাসের জন্য দিনের একটা নির্দিস্ট সময় ঠিক করে নিতে হবে এবং প্রাথমিকভাবে ৫ থেকে ১০ মিনিট সময় নিয়ে অভ্যাস শুরু করতে হবে । অভ্যস্ত হয়ে গেলে সময় নিজের সুবিধামত বাড়ানো যেতে পারে ।
১) মেডিটেশন অভ্যাসের জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন নিজের স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করা, তাই যতটা সম্ভব আরামদায়কভাবে মেঝেতে বা চেয়ারে বসতে হবে । মেঝেতে বসার ক্ষেত্রে কুশন বা আসন ব্যাবহার করা যেতে পারে । দুই পা স্বাভাবিকভাবে ভাঁজ করে বসা যেতে পারে । চেয়ারে বসে অভ্যাসের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখবেন যাতে পায়ের পাতা দুটি মেঝেতে স্পর্শ করে থাকে ।
২) বসার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবেন যাতে পিঠ, ঘাড় এবং মাথা সোজা অর্থাৎ সরলরেখায় থাকে । এর ফলে শ্বাস প্রশ্বাস সমানভাবে হওয়ার সুযোগ পায় এবং নিজের অবস্থিতি সম্পর্কে সর্বদাই অবহিত থাকবেন । মেঝেত বসে পিঠ সোজা রাখায় অসুবিধা মনে করলে পিঠ দেওয়ালে ঠেক দিয়ে বসা যেতে পারে । চেয়ারে বসে অভ্যাসের সময় সামনের দিকে সামান্য এগিয়ে বসতে হবে, যাতে পিঠ সোজা থাকে ।
৩) মেডিটেশন অভ্যাসের সময় হাতদুটির অবস্থান খুব গুরুত্ব পূর্ণ । চেয়ারে বা মেঝেতে উভয়ক্ষেত্রেই দুইহাতের তালু উর্দ্ধমুখী করে জ্ঞানমুদ্রায় দুই হাঁটুর উপর স্থাপন করতে হবে । এর ফলে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে যা অভ্যাসে সাহায্য করবে ।
৪) আরামদায়কভাবে বসে কয়েকবার স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস করতে হবে এবং কোনোধরনের সমস্যা আছে কিনা তা বুঝতে হবে । এইভাবে কয়েকবার শ্বাস প্রশ্বাস করার পরে সো-হাম মেডিটেশনের মূল পদ্ধতি শুরু করা যেতে পারে ।
৫) শ্বাস টানার সময় মনে মনে ‘সো’ মন্ত্রটি উচ্চারন করতে হবে এবং শ্বাস ছাড়ার সময় ‘হাম’ মন্ত্রটি উচ্চারন করতে হবে । অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে সম্পূর্ন মনোযোগ নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের উপর নিবদ্ধ করতে হবে যাতে মন্ত্র বলার সময় কোনো ভুল না হয় ।
প্রাথমিকভাবে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে শ্বাস প্রশ্বাস করলেও চলবে, কিন্তু অভ্যস্ত হয়ে গেলে আস্তে আস্তে শ্বাস টানার এবং ছাড়ার সময় বাড়াতে হবে এবং তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘সো’ এবং ‘হাম’ মন্ত্রোচ্চারনের সময়ও বাড়াতে হবে ।
৬) যতক্ষন সময় ধরে শ্বাস টানা হবে ততক্ষন সময় নিয়ে ‘সো’ মন্ত্রটি উচ্চারন করতে হবে এবং ঠিক একই ভাবে শ্বাস ছাড়ার সময় ধরে ‘হাম’ মন্ত্রটি উচ্চারন করতে হবে । তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে মন্ত্রোচ্চারনের সঙ্গে সময়ের তাল মেলাতে গিয়ে কোনোরকম তাড়াহুড়ো না হয়, এতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হয় ।
৭) মেডিটেশন অভ্যাস করার সময় চিন্তা ভাবনা অনেক সময় অন্য দিকে চলে যাবে, মাথায় নানারকম ভাবনা-চিন্তা আসবে, সেইসময় নিজের মনোযোগ নিজের শ্বাসকার্যের প্রতি নিবদ্ধ করতে হবে ।
প্রাথমিকভাবে সময়ের হিসেব রাখার জন্য ঘড়ির ব্যাবহার করা যেতে পারে, তবে আস্তে আস্তে ঘড়ির ব্যাবহার বন্ধ করে দেওয়া যেতে পারে । অভ্যাসের সময় শেষ হয়ে গেলে তখনি উঠে পড়া উচিৎ না, বরং আরও কিছুক্ষণ একইভাবে চোখ বন্ধ করে বসে স্বাভাবিক শ্বাসকার্য করে তারপরে স্থান ত্যাগ করা ভালো ।
সো-হাম মেডিটেশন অভ্যাসের ফলে যে উপকারীতা পাওয়া যায় তা যেকোনো মন্ত্র মেডিটেশন অভ্যাসের ফলে প্রাপ্ত উপকারীতার সমতুল্য । মেডিটেশনের সময় যেকোনো ধরনের মন্ত্র ব্যাবহারের মূল উদ্দেশ্য একাগ্রতা এবং মনোযোগ বৃদ্ধি ।
সো-হাম মেডিটেশন (So-Hum Meditation) অভ্যাসের ফলে নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তন হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে । দীর্ঘসময় ধরে নিয়মিত এই মেডিটেশন অভ্যাসের ফলে মানসিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যেখানে অনুশীলনকারী নিজেকে এই মহাবিশ্বের সবকিছুর অংশ হিসেবে ভাবতে সক্ষম হয়, ফলে অনেক বেশী মানবিক, দয়ালু এবং সহানুভূতিশীল করে তোলে ।
এছাড়াও যেকোনো মেডিটেশনের মতই মানসিক শান্তি অনুভব করার জন্য এবং সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও এই মেডিটেশন অভ্যাস করা যেতে পারে ।
সো-হাম মেডিটেশনের সঙ্গে ট্রানসেনডেন্টাল মেডিটেশনের বেশ কিছুটা সাদৃশ্য আছে, যেমন উভয় ক্ষেত্রেই নির্দিস্ট মন্ত্র ব্যাবহৃত হয় । উভয়ক্ষেত্রেই মন্ত্রোচ্চারন সাধারনত মনে মনে করতে হয় ফলে মনোযোগ নিজের শ্বাস প্রশ্বাস এবং মন্ত্র উভয়ের উপরে নিবদ্ধ রাখতে হয় ।
এই দুই ধরনের মেডিটেশনের যেমন সাদৃশ্য আছে ঠিক তেমনই বৈসাদৃশ্য আছে, যেমন ট্রানসেনডেন্টাল মেডিটেশনের ক্ষেত্রে একজন প্রশিক্ষক বা গুরু অনুশীলনকারীকে নির্দিস্ট একটা মন্ত্র দিয়ে থাকেন মেডিটেশন অভ্যাসের সময় উচ্চারনের জন্য কিন্তু সো-হাম মেডিটেশনের ক্ষেত্রে ‘সো’ এবং ‘হাম’ মন্ত্র ব্যাবহৃত হয় ।
সো-হাম মেডিটেশন (So-Hum Meditation) সংক্রান্ত যা তথ্য এখানে দেওয়া হল আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে । যদি এছাড়াও কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকে তাহলে নীচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন । ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।
আমরা সাধারনত একটা কথা বলে থাকি যে কোনোকিছুই অতিরিক্ত ভালো না । এই একই কথা…
শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই একটি বহুল প্রচলিত অভ্যাসের নাম হল “যোগ”…
‘স্বাস্থ্য’ কথাটা শুনলে আমরা সাধারনভাবে শুধু শরীরের কথাই ভেবেথাকি, ঠিক পদ্ধতিতে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের…
প্রাচীনকাল থেকে যেসকল কৃষিজ শষ্য মানবজাতির কাছে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তার মধ্যে ডাল (Lens…
সূচনা (Introduction) প্রোটিন (Protein) একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রোনিইট্রিয়েন্ট (Macronutrient) যার উৎস (protein sources) আমাদের প্রতিদিনের গ্রহন…
যোগাভ্যাসের বিভিন্ন ধরনের আসন, যা আমাদের দেহের নীচের অংশ যেমন পা, কোমর পেট এবং পিঠ…