হটযোগ প্রদীপিকা অনুসারে যত ধরনের প্রানায়মের কথা বলা হয়েছে, অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম (Anulom-Vilom Pranayama) সেগুলির মধ্যে অন্যতম । হটযোগ প্রদীপিকা অনুসারে এই প্রানায়ম নিয়মিত অভ্যাসের মাধ্যমে নাড়ির মধ্য দিয়ে প্রানশক্তির চলাচল নিয়ন্ত্রন করা সম্ভবপর হয় । যোগতত্ব অনুসারে আমাদের শরীরে প্রায় ৭২,০০০ সূক্ষ্ম নাড়ি আছে, যেগুলোর মধ্য দিয়ে সমগ্র শরীরে প্রানশক্তির সঞ্চালন হয় ।
অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম (Anulom – Vilom Pranayama) নিয়ে বিশদে জানার আগে অনুলোম – বিলোম শব্দদুটির মানে জেনে নিই । ‘অনু’ শব্দটির অর্থ ‘সহিত’ বা ‘দ্বারা’ এবং ‘বি’ শব্দটির অর্থ ‘বিপরীত’ বা ‘উল্টো’ । ‘লোম’ বা ‘লোমা’ শব্দটির অর্থ ‘অঙ্গরূহ’ বা ‘কেশ’ অর্থাৎ একসঙ্গে জুড়লে পুরো কথাটির অর্থ দাঁড়ায় ‘অঙ্গরূহের সপক্ষে বা পথে’ এবং ‘অঙ্গরূহের বিপক্ষে বা বিপরীতে’ ।
নাড়ি শোধন প্রানায়ামের মতই এই প্রানায়ামকেও বিপরীত নাসারন্ধ্র প্রানায়ম বলা হয়ে থাকে । অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে বেশ কিছু শারীরিক এবং মানসিক উপকারীতা পাওয়া যায় যেমন মানসিক চাপ হ্রাস পাওয়া, শ্বসনতন্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি ।
Table of Contents
যেকোনো ধরনের প্রানায়ম করার সবথেকে ভালো সময় হল সূর্যোদয়ের সময়ে অর্থাৎ ভোরবেলায়, কিন্তু নিজেদের সুবিধার্থে সকালে বা সন্ধ্যাবেলাতেও অভ্যাস করা যেতে পারে । তবে অভ্যাস শুরু করার আগে খেয়াল রাখতে হবে যাতে খাওয়ার পরে অন্তত ৩-৪ ঘন্টা তফাত থাকে । প্রানায়ম অভ্যাসের জন্য সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও হাওয়া চলাচল করে এমন জায়গা বেছে নেওয়া উচিৎ, এর ফলে প্রানায়ম অভ্যাসের সুফল তাড়াতাড়ি অনুভব করা যায় ।
১) প্রানায়ম অভ্যাসের জন্য সাধারনত মেঝেতে আরামদায়কভাবে দুই পা ভাঁজ করে (সুখাসনে) অথবা পদ্মাসনে বসতে হবে । তবে যাদের মেঝেতে বা হাঁটু ভাঁজ করে বসায় সমস্যা আছে, তারা চেয়ারে বসে অভ্যাস করতে পারবেন, কিন্তু সেক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে দুই পায়ের পাতা মাটি স্পর্শ করে থাকে । মেঝেতে বসার জন্য আসন বা কুশণ ব্যাবহার করলে তুলনামূলক ভাবে আরামদায়কভাবে বসা যায় ।
২) প্রানায়ম অভ্যাস করতে বসার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে মেরুদন্ড, ঘার এবং মাথা এক সরলরেখায় সোজা থাকে । এতে শ্বাস টানা বা ছাড়া অনেক সহজ হয় । একটানা সোজা বসতে অনেকে আসুবিধা বোধ করে থাকেন, সেক্ষেত্রে পিঠে বালিশ বা কুশণ দিয়ে ঠেক দিয়ে নিলে বসার সুবিধা হবে ।
৩) এতক্ষণ আমরা বসার ভঙ্গিমা বা অন্যান্য দিক গুলো জেনেছি, কিন্তু অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম অভ্যাসের ক্ষেত্রে হাতের যথেষ্ট গুরুত্ব আছে, তাই হাতের অবস্থানটাও জেনে নেওয়া প্রয়োজন । এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, আপনি যে হাতে বেশী স্বচ্ছন্দ সেই হাত ব্যাবহার করতে পারেন এবং তাতে কোন অসুবিধা নেই । বোঝানোর সুবিধার্থে এখানে ডান হাতের কথা বলা হয়েছে ।
ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা কে ভাঁজ করে হাতের তালুতে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠর নীচের অংশে ঠেকিয়ে রাখুন (বিষ্ণু মুদ্রা) । বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ আপনার ডান নাসারন্ধ্র বন্ধ করার জন্য এবং অনামিকা ও কনিষ্ঠা বাম নাসারন্ধ্র বন্ধ করার জন্য ব্যাবহার করবেন ।
৪) এবার আরামদায়কভাবে বসে কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস টানুন এবং ছাড়তে হবে, এর ফলে অভ্যাসকারী অনেকবেশী স্বচ্ছন্দবোধ করে প্রানায়ম অভ্যাসের সময় । এবার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান নাক বন্ধ করে, বাম নাক দিয়ে গভীরভাবে শ্বাস টেনে, ডান হাতের অনামিকা এবং কনিষ্ঠার সাহায্যে বাম নাক বন্ধ করে ডান নাক দিয়ে আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস ছাড়ুন ।
আবার বিপরীতভাবে বাম নাক বন্ধ অবস্থায় ডান নাক দিয়ে শ্বাস টেনে, বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান নাক বন্ধ করে, বাম নাক দিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়ুন ।
৫) দুইনাক দিয়ে শ্বাস টানা এবং ছাড়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার মানে একবার অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম করা হল । এই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রাথমিকভাবে ৭-১০ বার করে ৩ সেট করা যেতে পারে । তবে ৭-১০ বার শ্বাস টানা ছাড়ার পরে অবশ্যই ২০-৩০ সেকেন্ড স্বাভাবিক শ্বাসকার্য করতে হবে ।
অভ্যস্ত হয়ে গেলে আস্তে আস্তে সময় বাড়িয়ে ১০-২০ মিনিট পর্যন্ত প্রানায়ম অভ্যাস করা যেতে পারে ।
এখানে পড়ুন – নাড়ি শোধন প্রানায়ম
১) প্রতিদিন প্রানায়ম অভ্যাসের পরে ৫-১০ মিনিট meditation অভ্যাস করা দরকার । এতে শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয় তাছাড়া meditation এর উপকারীতাগুলিও উপভোগ করা যায় ।
২) নাক বন্ধ করার সময় অযথা নাকের উপর জোরে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নেই । হালকা চাপ প্রয়োগ করলেই হবে ।
৩) এই প্রানায়ম অভ্যাসের সময় নিঃশ্বাস ধরে রাখার প্রয়োজন নেই । তার সঙ্গে এটাও খেয়াল রাখতে হবে যাতে শ্বাস টানা বা ছাড়া কোনোটাই যেন খুব দ্রুত না হয় ।
এই প্রানায়ম অভ্যাসের সময় একজন অভ্যাসকারী মনোযোগ সহকারে শ্বাস টানা এবং ছাড়া প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে, যার ফলে একাগ্রতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পায় । এছাড়াও প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শরীর ও মন শান্ত হয় । সুতরাং প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্তত ৫ মিনিট প্রানায়ম অভ্যাস করা যায়, তাহলে তা গোটা দিনের কার্যকলাপের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে ।
শ্বসনতন্ত্র সুদৃঢ় করে – নিয়মিত অভ্যাসের ফলে ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে ফুসফুসজনিত সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, এছাড়াও অ্যাস্থমা, ব্রঙ্কাইটিসের মত রোগের সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা তৈরী হয় ।
হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে – নিয়মিত অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে শরীরে অক্সিজেনের প্রাচুর্য ঘটে, যার ফলে অক্সিজেন সম্বলিত পরিশ্রুত রক্ত হৃদপিন্ডে প্রবেশ করে এবং হৃদযন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করতে এবং সুস্থ রাখতে সাহায্য করে ।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে – মানসিক স্থিতি এবং সমগ্র শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিকভাবে কার্যকলাপের জন্য সঠিকভাবে রক্ত চলাচল খুবই প্রয়োজনীয় । একটা গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত থাকে এবং রক্ত চলাচল সঠিক ভাবে হয় ।
সাইনাসের সমস্যা দূর করে – প্রতিদিন প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে নাসারন্ধ্রের প্রতিবন্ধকতা দূর করে শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ সহজ করে তোলে । এর ফলে সাইনাসের সমস্যা দূর হয় এবং সর্দি-কাশির মত রোগ ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করে – ত্বক আমাদের শরীরের সবথেকে বড় অঙ্গ এবং আমরা জানি মানসিক চাপ উদ্বেগের কারনের ত্বকের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে । নিয়মিত প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমে এবং ত্বকের স্বাস্থ্যন্নোতি হয় ।
হজমশক্তি বৃদ্ধি করে – প্রানায়ম অভ্যাসের ফলে পাচনতন্ত্রের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে পরিপাক ক্ষমতা বাড়ে । সঠিক পরিপাক প্রণালী অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতা কমাতে সাহায্য করে । এক্ষেত্রে একটা বিষয় বুঝতে হবে, যে শুধুমাত্র প্রানায়ম অভ্যাস্ করলেই ওজন হ্রাস পায় না । তার সঙ্গে সঠিক খাদ্যাভ্যাস একান্ত প্রয়োজন ।
উপরোক্ত উপকারীতাগুলির পাশাপাশি কিছু মানসিক সুফল দেখা যায় যেমন একাগ্রতা বৃদ্ধি, মানসিক চাপ এবং উত্তেজনা হ্রাস, ইতিবাচক মনোভাব, অবষাদ কমা ইত্যাদি ।
পদ্ধতিগত দিক থেকে দুই প্রকার প্রানায়ম একই রকম, এবং অনেক ক্ষেত্রেই এগুলিকে একটা প্রানায়ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে । তবে দুই ধরনের প্রানায়মের মধ্যে পার্থক্যটি হল –
** নাড়ি শোধন প্রানায়মের ক্ষেত্রে শ্বাস টানার পরে অভ্যাসকারীর ক্ষমতা অনুযায়ী শ্বাস ধরে রেখে তারপরে বিপরীত নাক দিয়ে আস্তে আস্তে শ্বাস ছাড়তে হয়
** অনুলোম – বিলোম প্রানায়মের ক্ষেত্রে শ্বাস টানার পরে শ্বাস ধরে রাখার কোনো ব্যাপার নেই । সঙ্গে সঙ্গেই বিপরীত নাক দিতে আস্তে আস্তে শ্বাস ছেড়ে দেওয়া যায় ।
সাধারনভাবে এই প্রানায়ম অভ্যাস করার জন্য কোনো সতর্কীকরনের প্রয়োজন নেই এবং প্রায় প্রত্যেকের জন্যই সুরক্ষিত । তাসত্ত্বেও প্রাথমিকভাবে যারা শুরু করতে চলেছেন, তারা একেবারেই অনেকটা সময়ের জন্য অভ্যাস করবেন না । প্রথমে অল্প সময় নিয়ে শুরু করুন, তার পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সময় বাড়াতে পারেন । যাদের হৃদরোগ বা ফুসফুস জনিত রোগের শিকার তারা অবশ্যই শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নেবেন পুর্বাহ্নিক সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা হিসেবে ।
অনুলোম – বিলোম প্রানায়ম একটি সহজ যোগ অভ্যাস যা প্রত্যেকে নিজের বাড়িতে কোনোরকম সরঞ্জাম ছাড়াই অনুশীলন করতে পারেন । সুতরাং নিজেকে আরও একটু সুস্থ রাখতে এবং মানসিকভাবে চাঙ্গা করে তুলতে প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট প্রানায়ম অভ্যাস শুরু করুন । এখানে সহজ এবং সরল পদ্ধতিতে প্রানায়ম অনুশীলনের পদ্ধতি আলোচনা করা হয়েছে, যা আপনাদের সাহায্য করবে ।
এই সংক্রান্ত কোনো প্রশ্ন বা মতামত থাকলে নীচে কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন । ইমেল বা মেসেজের মাধ্যমেও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন ।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন এবং অন্যদের সুস্থ থাকতে উৎসাহিত করুন ।
আমরা সাধারনত একটা কথা বলে থাকি যে কোনোকিছুই অতিরিক্ত ভালো না । এই একই কথা…
শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধনের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই একটি বহুল প্রচলিত অভ্যাসের নাম হল “যোগ”…
‘স্বাস্থ্য’ কথাটা শুনলে আমরা সাধারনভাবে শুধু শরীরের কথাই ভেবেথাকি, ঠিক পদ্ধতিতে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের…
প্রাচীনকাল থেকে যেসকল কৃষিজ শষ্য মানবজাতির কাছে খাদ্যবস্তু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে তার মধ্যে ডাল (Lens…
সূচনা (Introduction) প্রোটিন (Protein) একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাক্রোনিইট্রিয়েন্ট (Macronutrient) যার উৎস (protein sources) আমাদের প্রতিদিনের গ্রহন…
যোগাভ্যাসের বিভিন্ন ধরনের আসন, যা আমাদের দেহের নীচের অংশ যেমন পা, কোমর পেট এবং পিঠ…